নদীটার নাম মুসি। কিন্তু আরেক নদী আছে। কী যেন নাম তার? বুকের ভেতর কেঁদে-কেঁদে নদীটা কোন্ এক নাম-না-জানা সমুদ্রে হারিয়ে যায়। পূর্ণিমার আকাশে...

মুসি নদী, ফ্র্যাকটাল জ্যামিতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ -- আজফার হোসেন

8:56 PM Editor 0 Comments


নদীটার নাম মুসি।


কিন্তু আরেক নদী আছে। কী যেন নাম তার? বুকের ভেতর কেঁদে-কেঁদে নদীটা কোন্ এক নাম-না-জানা সমুদ্রে হারিয়ে যায়। পূর্ণিমার আকাশে দগদগে ক্ষতের মতো চাঁদটা অবশেষে ঢেউয়ের ভেতরে ভেঙে-ভেঙে চুরমার হতে থাকে। মুসি নদীটা কেন জানি সেই অচেনা নদী আর সেই আকৃতিহীন চাঁদটার কথা মনে করিয়ে দেয়। কান্নার কথাও মনে আসে। নদীর কান্না শুনেছি কতো রাত! 


মরা আত্রাইয়ের পারে একবার একটা কাটা মুণ্ডু দেখেছিলাম, যখন আমার ছেলেবেলা ছিল। আত্রাই! আত্রাই! তুমি কি মরে যাচ্ছ? কতো রাত ভেতরের নৈঃশব্দ্যকে খানখান ক'রে ভেঙে দিয়ে এই প্রশ্নটাকে আর্তনাদের মতো ধ্বনিত হতে শুনেছি। আত্রাই কেঁদে-কেঁদে ফেরে; ভেতরে সেই কান্না আবার জমাট বরফ হয়ে যায় একসময়; অতঃপর উত্তাপের অপেক্ষায় থাকে। 


আজকাল খুব বেশি মনে হয়, যে মানুষের কান্না শোনে নাই, সে কখনও নদীর ধারে যায় নাই। যে নদীকে চেনে নাই, সে ডুকরে-ডুকরে ওঠা সময়ের কান্না শোনে নাই। বনলতা, বড় সাধ হয়, তোমাকে নিয়ে যাই সেই নদীটার ধারে, যে নদীটার নাম আজও জানা হয় নাই।


হ্যাঁ, নদীটার নাম মুসি। নামটা প্রথম শুনেছিলাম যোসেফের মুখে। যোসেফই বললেন, একসময় নদীটা হায়দ্রাবাদ নগরীর পাঁজর ঘেঁষে বয়ে যেতো; আর আজ সে বয়ে যাচ্ছে নগরীর বুক চিরে। অর্থাৎ নদীর ওপারের এলাকাতে নগরী বেড়েই চলেছে। পুঁজির ফটকাবাজিতে বৃদ্ধি, বিস্তার আর বৈপরীত্যই তো নগর'সভ্যতা'র অন্যতম মন্ত্রঃ সারা পৃথিবী জুড়ে নগরগুলো বাড়তে থাকে, কেবল বাড়তেই থাকে। আর গ্রাম ভাঙনের শব্দ নাম-না-জানা সেই নদীটার মতোই কাঁদতে থাকে, কাঁদতেই থাকে। সময়ও শুনে যায়, কেবল শুনে যায় সেই কান্না।


বাড়তে-বাড়তে হায়দ্রাবাদের সহোদর এভাবেই জন্ম নেয়। এর নাম সেকান্দারাবাদ। হাত ধরাধরি করে থাকে তারা। এদের শহরতলী আবার ষোলো মাইল পর্যন্ত এলিয়ে আছে। প্রায় তিরিশ লাখ এদের জনসংখ্যা। দাক্ষিণাত্যের এক মালভূমির ওপর চোখ-ধাঁধানো নেশা-ধরানো চারশো বছরের একজোড়া নাচতে-থাকা নগরীর নাম হায়দ্রাবাদ-সেকান্দারাবাদ। 

 লোরকার কবিতার সেই চিত্রকল্পটা মনে আসে। সমুদ্রের অতল থেকে নুন-মাখা শরীর নিয়ে জেগে উঠেছে এক নারী; সমুদ্র থেকে অনেক ওপরে চলে যাচ্ছে সে; পাস্কালীয় শূন্য স্পেসে মুদ্রা কেটে-কেটে নাচতে-নাচতে সে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

কিন্ত, হায়দ্রাবাদ-সেকান্দারাবাদ মোটেই আতঙ্কিত নয়; তারা আনন্দিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৬০ ফুট ওপরে তাদের শরীর সেকি অটুট! নাচের মুদ্রায় তারা সেকি স্বতঃস্ফূর্ত! অন্ধ্র প্রদেশের বুকের ওপর আলো-নিসর্গ-নদী-মাটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে নেচে চলেছে, ভারতের [তখন] পঞ্চম বৃহত্তম নগরী, অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী। তখন বলা হোত, পৃথিবীর সুন্দরতম নগরীগুলোর একটি হায়দ্রাবাদ।


সেদিন আমরা যাচ্ছিলাম হায়দ্রাবাদের গোলকোন্ডা কেল্লায়। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে; বাস ছুটে চলেছে নগরীর রাস্তায়; বাসের ভেতরে আমরা ছিলাম প্রায় বিশ জন; আমাদের কোলাহল, কথোপকথন, নৈঃশব্দ্য, চিন্তাও ছিল। রঞ্জনার হাসি শুনতে পেলাম; বাসের মাঝখানে জানালা-ঘেঁষা একটা আসন তখন আমার দখলে, বাইরে তাকিয়েই দেখা যায় ড্রাগষ্টোর, সাইনবোর্ড, কলেজ, গাড়ি, ধোঁয়া, হুসেন সাগর, মানুষ--সবই ছুটে চলেছে, সবই ক্ষণস্থায়ী, টুকরো-টুকরো, সবই থাকে, আবার থাকেও না। ভালো লাগলো, আবার অসহায় বোধ করলাম। 


মনে হলো, ওই জানালা হঠাৎ ভেঙে গেলো; মনে হলো, বাসের বডিটা খুলে পড়লো, ছুটে-চলা বাসের ভেতর থেকে আমি পড়ে গেলাম, শুরু হলো আরেক ছুটে চলাঃ ২৪ আগস্ট উদ্ভাসিত হলো, নোংরা পুড়ে-যাওয়া অথচ সুন্দর-শীতল ঢাকার মুখ সামনে এলো; বুকের ভেতর দাউ-দাউ আগুন জ্বলে উঠলো; ২৪ আগস্ট-এ যে কাছে এসেছিলো সময়ের আর প্রেমের কবিতা হাতে নিয়ে আর শুনিয়ে-শুনিয়ে, সে এখন কি ফিরে গেছে সেই ভয়াল নাম-না-জানা শহরে?... ইঁদুর কেটে ফেলেছে সমস্ত গ্রন্থি, আমার পুরাতন টেবিলের একটা বুড়া- থুত্থুরে পায়া চলে গেছে ঘুনের দখলে...সংবিধান উইপোকার দখলে, নাকি সংবিধান এখন বিধানের সঙ?...পতাকা এখন ইঁদুরের দাঁতে; পার্লামেন্টে মাকড়সার জাল বাড়ছে। 


মাকড়সা মানেই 'ফ্র্যাকটাল' জ্যামিতি... একবার, মনে পড়ে, ওই জ্যামিতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম... শালার 'ফ্র্যাকটাল'! ত্রিভুজের দু'টো বাহু উড়িয়ে দিয়ে তাকে আস্তো একটা রম্বসে পরিণত ক'রে তিনটে বৃত্তকে এদিক-সেদিক ঠেসে-ঠুসে হাতের ভেতরে একটা বিশেষ শেপ অনুভব করার নান্দনিক-শারীরিক আনন্দের অন্বেষণে তোমার কাছে গিয়েছিলাম হে 'ফ্র্যাকটাল' জ্যামিতি! এও বুঝেছিলাম, জ্যামিতি দু'টো জিনিস বোঝে ভালো--এক, দেহতত্ত্ব ও দুই, রাজনীতি। হ্যাঁ, রাজনীতি আর দেহতত্ত্ব ছাড়া জ্যামিতি জমে না মোটেই।


"কী চুপচাপ যে? আমার পাশ থেকেই প্রশ্নটা এলো, আনন্দ শর্মার কাছ থেকে। বাসের খুলে-যাওয়া জানালাটা ধপ্ করে লেগে গেলো, বাসের বডিটাও ঝট করে আকৃতি ফিরে পেলো; পড়ে-যাওয়া 'আমি' তখন বাসের ভেতরে জানালার পাশের সিটে বসে আনন্দ শর্মার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কী বলবো? হঠাৎ মনে হলো বলিঃ আমার জিহ্বাটা কে যেন কেটে ফেলেছে গত রাতে। তারপর মনে হলো, এমনি একটা
উত্তরকে নিছক পাগলামি ঠাউড়াবেন ইংরেজি সাহিত্যের নেপালী শিক্ষক আনন্দ শর্মা। তাই বললামঃ না, বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম।


[আমার এক পুরানো দিনের ভ্রমণকাহিনী থেকে। চলবে।]


0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.