ভাল্টার বেনজামিন ও গুরুত্ব বিচারের স্বাতন্ত্র্য || আজফার হোসেন
জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখ্ট্ চমকে উঠেছিলেন। এবং হতাশও হয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতে পারলেন, দীর্ঘ ২০ বছর ভাল্টার বেনজামিন কোনো না কোনোভাবে মার্কসবাদী অবস্থান বা ধ্যান-ধারণা থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন বা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু মার্কসের পুঁজি না পড়েই।
তখন ১৯৩৮ সাল। এর বেশ আগে, অর্থাৎ ১৯১৬ সালে, বেনজামিন ভাষা নিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ‘থিসিস’ হাজির করেন। এসব থিসিসে অসংখ্য ইঙ্গিত-ভারাক্রান্ত ধারণা উপস্থিত হয়েছে, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে হাল আমলের উত্তরকাঠামোবাদী ভাষিক চিন্তা-ভাবনার উজ্জ্বল পূর্বাভাসও বটে—বিশেষ করে এই ধারণাটা যে, ভাষা বাস্তবতার প্রতিফলক নয়, বরং ভাষা বাস্তবতার সঙ্গে যোগসাজশে বাস্তবতাকেই তৈরি করে। ৫ বছর পরেই, অর্থাৎ ১৯২১ সালে, বেনজামিন লেখেন আরেক থিসিসধর্মী রচনা, যার শিরোনাম ‘ক্রিটিক অব ভায়োলেন্স’, যেখানে তিনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের বিষয়টিকে ‘বৈধ সন্ত্রাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বটে, কিন্তু এও বলেছেন যে, এই ‘সন্ত্রাস’কেও জবাবদিহি করতে হয় ‘ফিফথ’ কমান্ডমেন্ট’-এর কাছে (অবশ্যই ‘সন্ত্রাস’-এর পরিসর বেনজামিনের বয়ানে এর চেয়েও ব্যাপ্ত)। তবে কথাগুলো এখানে দ্রুত বলে নেওয়া হলো অন্তত এই ইঙ্গিতটা দেওয়ার জন্য যে, বেনজামিন মার্কসবাদের সাংস্কৃতিক বয়ানের তুলনামূলকভাবে অলক্ষিত দিগন্তের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন।
এও বলা দরকার, বেনজামিনকে চেনার একটি সূত্র হতে পারে তার প্রবণতার বৈচিত্র্য। তিনি মার্কসবাদী, আবার মরমি বা মিস্টিকও। তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কথা বিশেষভাবে বলেছেন, আবার পবিত্র তালমুদ বা গাঁজার মতো মাদকদ্রব্যকেও বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এ কারণে অনেকের কাছেই বেনজামিনকে ‘অদ্ভুত’ মনে হয়।
১৮৯২ সালে বার্লিনে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াল্টার বেনজামিন। মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি একটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতা হন। বালিংন ও মিউনিখে পড়াশোনা করলেও একসময় সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা হন। সেখানেই ১৯১৯ সালে সুইজারল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেন। তার অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘দ্য কনসেপ্ট অব ক্রিটিসিজম ইন জার্মান রোমান্টিসিজম’। ১৯২০ সালে তিনি ফিরে আসেন বার্লিনে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার জন্য তিনি সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা শুরু করেন এবং সংস্কৃতি-সমালোচক হিসেবে বেশ পরিচিতি ও খ্যাতিও লাভ করেন। জীবনের অনেক সময় ধরেই বেনজামিন অন্তত দু’জন মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন জার্মান নাট্যকার- তাত্ত্বিক-অ্যাক্টিভিষ্ট বের্টোল্ট ব্রেখ্ট্ এবং অপরজন হাঙ্গেরীয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক গেয়র্ক লুকাচ। বেনজামিনের বুদ্ধিভিত্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই একটা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ফ্র্যাংকফুর্ট স্কুল’, যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একাধিক মার্কসবাদী তাত্ত্বিক—ম্যাক্স হর্খেইমার, থিওডর অ্যাডোর্নো, ফ্রেডরিক পলোক, এরিক ফ্রম, হাবার্ট মার্কুস এবং ফ্রানৎস নিউম্যানসহ আরো অনেকে।
প্রতিষ্ঠানের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে এ কারণে যে, এই ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের সদস্যদের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে বেনজামিনের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার সংঘর্ষ ও সংহতিতে সম্ভব হয়েছিল তার ‘মার্কসবাদ’কে বিশেষত্ব দেওয়া। বলা প্রয়োজন, এই স্কুলের অভ্যন্তরে মার্কসবাদ ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে এক ধরনের বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল, যার এক অক্ষে অবস্থান করছিলেন বের্টোল্ট ব্রেখট, বেনজামিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং বিপরীত অক্ষে ছিলেন অ্যাডোর্নো ও হর্খেইমার, যারা বেনজামিনকে ব্রেখটীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে রীতিমতো সাবধান করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, মার্কসবাদী শিল্পচর্চার অর্থ এই নয়, শিল্পকে কমিউনিষ্ট মতাদর্শের প্রচারধর্মী বাহনে রূপান্তরিত করতে হবে।
কিন্তু বেনজামিন ঝুঁকেছিলেন ব্রেখটের দিকেই; মার্কসের বিহেগেলীয়করণের দিকেও। হ্যাঁ, বেনজামিন জোরেশোরেই ‘হেগেলীয়’ মার্কসবাদীদের ‘জার্গন’ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে বেনজামিনের মার্কসবাদ এবং ব্রেখটের মার্কসবাদ অভিন্ন নয়। কিন্তু তাদের ঐক্যটা অন্তত এই জায়গায়: উভয়ের অঙ্গীকার ছিল শিল্পকে গণমুখী করার। হ্যাঁ, উভয়ের পক্ষপাত ছিল ‘পপুলার কালচার’-এর প্রতি।
বলা দরকার, এই সংস্কৃতিকে ফ্রাংকফুর্ট স্কুল বরাবরই মনে করেছে শিল্পবিরোধী, অনান্দনিক। ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের, বিশেষ করে থিওডর অ্যাডোর্নোর, বক্তব্য ছিল এটাই যে ‘পপুলার কালচার’ পন্য সংস্কৃতির প্রভাবে পরিচিত ইডিয়ম, ফর্ম, সুর, স্বর ও ভাষার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বদ্ধ বৃত্ত সৃষ্টি করে, যে বৃত্ত দ্বান্দ্বিক চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করার পরিবর্তে তাকে কারারুদ্ধ করে রাখে। এর উত্তর বেনজামিন দিয়েছেন নিজেই, তার বোধ করি সর্বাধিক পরিচিত রচনা ‘দ্য ওয়ার্ক অব আর্ট ইন দ্য এইজ অব মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’- এ (১৯৩৬)। এখানে বেনজামিন একাধিক বিষয়ের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ন ধারণাটাকে সামনে আনেন: ফ্যাসিবাদ যেখানে রাজনীতিকে নান্দনিক করে, কম্যুনিজম সেখানে নান্দনিকতার (বা শিল্পের) রাজনীতিকীকরণ ঘটায়। বিষয়গুলো নিয়ে পরে সামান্য আলোচনা করা যাবে। কিন্তু এখন বেনজামিনের কাজের দু-একটা গুরুত্বপূর্ন দিককে স্পর্শ করা যাক।
২
সনাতন অর্থে যাকে ‘মূল্যায়ন’ বা ‘সমালোচনা’ বলে, সেটা করেননি ভাল্টার বেনজামিন। বরং তিনি উপস্থিত করেছেন পাঠের পর পাঠ, যেখানে চিন্তার ঝলকানি ধরা পড়ে চিত্রকল্পে, যেখানে ইঙ্গিতে-ইঙ্গিতে বক্তব্য এবং তার অর্থ দারুণ স্থিতিস্থাপক হয়ে ওঠ, যেখানে ক্ষেত্রবিশেষে সিদ্ধান্তগুলোকে অসম্পূর্ন এবং অনিশ্চিত, কিন্তু সম্ভাবনাময় ঠেকে। বেনজামিন নিজেই তো পৃথিবীকে তুলনা করেছেন এক ধ্বংসের নগরীর সঙ্গে; এবং এও ইঙ্গিত করেছেন যে, এই নগরী থেকে নির্দিষ্ট কোন অর্থ আসবে না বলে অর্থ পালিয়ে গেছে। বেনজামিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ইঙ্গিত আছে। এই ইঙ্গিতটি সাম্প্রতিককালের চিহ্নবাদী মার্কসবাদ বা বলা যায়, গোটা চিহ্নতত্ত্বকেই প্রভাবিত করেছে। সেটা হলো এই যে, যা কিছু বর্তমান তা একটি অনুপস্থিত ‘সত্য’কে নির্দেশ করতে চায় এবং চোখের সামনে মূলত একটা চিহ্ন হিসেবেই উপস্থিত হতে চায়, যে চিহ্নকে পাঠ করা যায় অনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে। অর্থের আছে কমপক্ষে ৪৯টি স্তর—এমনি এক ‘ক্যাবলিস্ট’ বা তালমুদীয় শিক্ষা বেনজামিনকে আকৃষ্ট করেছিল শুরু থেকেই।
বেনজামিনের মার্কসবাদী অবস্থান থেকেও মাঝে মাঝে এই ইঙ্গিতটা উঠে আসে যে, ‘ডায়ালেকটিক্স’ নিজেই তো অর্থের স্থিতি বা একমাত্রিকতাকে না করে দেয়। কেননা, ‘ডায়ালেকটিক্স’ বরফের মতো জমাটবাধা কোনো প্রতীকী অবস্থান নয়, বরং এক গতিশীল, নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ সুবোধ বালকের মতো স্কুলের ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ এ দাড়িয়ে থাকতে পারে না, বরং সে ছুটে চলে দ্বন্দের ভেতর দিয়ে এবং সংঘর্ষের অনিবার্য চাপে। ডায়ালেকটিক্সের এই অর্থ সৃষ্টি নিয়ে অবশ্য অনেক বিতর্ক আছে। তবে আমি এখন সেদিকে যাচ্ছি না। বরং আমরা এখন বেনজামিনের পাঠের দিকেই তাকাই।
বেনজামিন একাধিক পাঠই হাজির করেছেন, যেগুলোকে সামগ্রিকভাবে স্পর্শ করা বর্তমান লেখার অল্প পরিসরে দুঃসাধ্য। তবে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় বোদলেয়র, কাফকা ও প্রুস্তের পাঠের কথা। বেনজামিনের সেই বোদলেয়র পাঠ তো রীতিমতো বিখ্যাত, বিশেষ করে বেনজামিনের কাজ ‘অন সাম মোটিফস ইন বোদলেয়র’ (১৯৩৯)। এখানে একাধিক বিষয়ের মধ্যে বেনজামিন বিশেষ করে তিনটি বিষয়ে—শ্রেণী, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি বিষয়ে—তার ধারণাকে উপস্থিত করেছেন। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়েই এসব ধারণাকে তিনি সামনে এনেছেন এবং বেনজামিনের বোদলেয়র-পাঠে আমরা লক্ষ্য করি ফ্রয়েড ও লুডভিগ ক্লাগেসের ফ্যাসিবাদী নৃ-তত্ত্বের কিছু কৌশলের পাল্টা-প্রয়োগ।
বস্তুক ও আধ্যাত্মিক ইডিয়মের রসায়নই বেনজামিনকে টেনেছে বোদলেয়রের দিকে। ধারণাটি যথার্থ দিয়েছেন সমালোচক রিচার্ড কার্নি। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বোদলেয়রের কবিতায় বেনজামিন দেখেছেন সেই ভবঘুরে প্রবণতাকে, যার উপস্থিতি সম্ভব কেবল বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে, পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদের জমে-ওঠা পর্যায়ে। এই ভবঘুরে বা বোদলেয়রের যাযাবর যে অভাবনীয পথ-পরিক্রমা রচনা করে, সেটা বন্ধ আর্কেডকে ভেঙে দিয়ে উন্মুক্ত, প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করেছে। বেনজামিনের বিবেচনায়, বোদলেয়রের ভবঘুরে সত্তা যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, সে রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট নেই, বরং আছে বৃক্ষশ্রেণী। এভাবে বেনজামিন তাঁর বোদলেয়রকে দাঁড় করাচ্ছেন পুঁজিবাদ-প্রভাবিত বদ্ধ নগরায়নের বিরুদ্ধে। বোদলেয়রের নগর-দর্শনকে বেনজামিন গভীর মনোযোগসহকারে পাঠ করেছেন। প্যারিসের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অর্থ ঘড়ির কাঁটা ধরে প্রগতি কিংবা গতিকে নির্ণয় করা নয়, বরং সেই অর্থকে বোঝা বা চালনা করা, যা কেবল স্পেসেই নির্ণয়যোগ্য। বেনজামিনের বিবেচনায় পুঁজিবাদী-বুর্জোয়া মতাদর্শ সময়ের রৈখিক ক্রমকে সমাদর করে, কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রশ্রয় দেয় স্পেসের অরৈখিকতাকে, যেখানে স্পেসেই শ্রেণী সংগ্রামের অনুপুঙ্খকে প্রত্যক্ষ করা যায়।
বোদলেয়র ‘সময়’-এর কবি নন, বরং ‘স্পেস’-এর কবি—এই ধারণাটাকে সামনে এনেই বেনজামিন বোঝাতে চেয়েছেন যে, বোদলেয়র সেই কবি যিনি উনিশ শতকের ফরাসি বুর্জোয়া মতাদর্শকে, বুর্জোয়া স্থিতি ও নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। যন্ত্রের দিকে ঝুঁকে-পড়া আর ঘড়ির কাঁটা দিয়ে বাস্তবতাকে নিউটনীয় কায়দায় মেপে-মেপে পুরা স্পেসকে (শোষণের ক্ষেত্রকে) আড়াল করার বুর্জোয়া কৌশলকে বোদলেয়র নাকচ করেছেন বলেই মার্কসবাদী বেনজামিনের কাছে বোদলেয়র অনুপ্রেরণা হয়ে থাকেন, যার সুবাদে বেনজামিন বলেছিলেন বিপ্লবের ‘টপোলজি’র (স্থানতত্ত্বের) কথা। বেনজামিন যে ফটোগ্রাফির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, তারও একটা কারণ হচ্ছে বেনজামিনের স্পেসপ্রীতি ও বোদলেয়রপ্রীতি। ফটোগ্রাফি, বোদলেয়রের চিত্রকল্পের মতোই, সময়কে মহাকালের কাছে বলি না দিয়ে তাকে ধারণ করে স্পেসের ভেতর। অন্য কথায়, ফটোগ্রাফি সময়কে স্পেসে রূপান্তরিত করে। কিন্তু এও সত্য যে, বেনজামিনের কাছে ফটোগ্রাফি কিংবা স্পেস কোনো নির্দিষ্টবাচকতা বা একরৈখিকতা বা নিশ্চিতিকে নির্দেশ করে না; সেখানেও অর্থ ঊনপঞ্চাশটাই হতে পারে এই অর্থে যে, পঠন তো আর থেমে থাকে না। সেও বোদলেয়রের ভবঘুরের মতোই ছুটে চলে ঊনপঞ্চাশটি পথে। অর্থাৎ স্পেস মানেই কোনো জমাটবাঁধা স্থান নয়।
বোদলেয়রের কাছ থেকে বেনজামিন যে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাটি লাভ করেন, তা হচ্ছে নগরীর অভিজ্ঞতা। বেনজামিন মনে করেন, একেকটি নগরী হচ্ছে একেকটি ‘ছোট পৃথিবী’, যেখানে ইতিহাসের অর্থগুলো বিভিন্ন বস্তুর কোলাজে ধরা পড়ে, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও। নাগরিক প্রাত্যহিকতায় কিংবা নগরীতে সংঘটিত বড় সাধারণ ও ক্ষুদ্র ঘটনায় বিপ্লবের ব্যঞ্জনা লুকিয়ে থাকতে পারে বলে বেনজামিন মনে করেছেন। এই কারণে তিনি মাছের বাজার কিংবা বেশ্যালয় কিংবা রাস্তার ধারের জটলা কিংবা চায়ের দোকানের আলাপকে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন এবং এও দেখা গেছে যে, রেস্টুরেন্টের আড্ডা থেকে উঠে আসা কোনো ‘ক্লিশে’কে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে আনা কোনো গুজবকে বেনজামিন রীতিমতো রাডিক্যাল প্রবচনে রূপান্তরিত করেছেন। এও বোদলেয়র-পাঠের ফসল বৈকি।
ঔপন্যাসিক কাফকাকেও বেনজামিন গভীর মনোযোগসহকারে পাঠ করেছেন। এই পাঠের ভেতর দিয়ে বেনজামিন একটি উত্তেজক চিন্তাকে সামনে আনলেন। সেটি হলো প্রতীক এবং ‘অ্যালেগরি’র মধ্যে পার্থক্য নিয়ে চিন্তা। বেনজামিনের মতে, প্রতীক অভিজ্ঞতা-নির্ভর; সে রৈখিক যোগাযোগকে অনায়াসে নির্দেশ করতে পারে (‘ক’ প্রতীক হলে প্রতীকায়িত হয় ‘খ’) এবং এভাবে প্রতীকের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে ধারাবাহিকতা বা অনুচ্ছেদ। কিন্তু ‘অ্যালেগরি’র বৈশিষ্ট্য ধারাবাহিকতা নয়; তার বৈশিষ্ট্য ছেদ ও ভেদ। বেনজামিন-নির্দেশিত এই পার্থক্যটিকে হয়তো এভাবে বোঝানো যেতে পারেঃ ‘প্রতীক’ অনেকটা প্লাস্টিক ফিতার মতো, তাকে টানা যায় (অবশ্য একটি পর্যায় পর্যন্ত) এবং এই ফিতা দিয়ে ঐক্যের সূত্রে হয়তো ঈশ্বর, মানুষ আর প্রকৃতিকে বেঁধে ফেলা যায়;আর অন্যদিকে ‘অ্যালেগরি’ হচ্ছে কেটে -যাওয়া অদৃশ্য সুতা। তাই ‘অ্যালেগরি’তে ঈশ্বর-মানুষের মিলন জমে ওঠে না, বরং সে ধারণ করতে পারে মৃত্যু, বিষাদ আর বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতাকে। প্রতীকবাদে ‘ডিভাইন’ আসন্ন কিংবা উপস্থিত; কিন্তু ‘অ্যালেগরি’তে সে অনুপস্থিত। বেনজামিনের মতে, ‘অ্যালেগরি’ রেখে যায় অনুপস্থিতির চিহ্ন, অনুপস্থিতির অবিন্যস্ত আঁকিবুঁকি। এই আঁকিবুঁকি, এই অনুপস্থিতি, এই কেটে-যাওয়া সুতাটাকে ভাল্টার বেনজামিন দেখেছেন তাঁরই মতো ‘জর্মন’ ইহুদি লেখক ফ্রানজ কাফকার উপন্যাসে।
কাফকা প্রতীকের নন, তিনি মূলত অ্যালেগরির। সেই অ্যালেগরিতে বেনজামিন খুঁজে পেয়েছেন আধুনিকতাবাদী অভিজ্ঞতার সারাৎসার। বেনজামিন বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন কাফকার ভাষাকে, তার আধুনিকতাবাদী ভাষিক অভিজ্ঞতাকে এবং সেই অভিজ্ঞতার নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকটাকেও। এই দিকটা হলো কাফকার ভাষার অনিবার্য ‘ইহুদিত্ব’, যা তার ভাষাকে ‘এলিয়েন’ করে রেখেছে। জর্মন ভাষা তার নিজস্ব নয়, অথচ জর্মন ভাষায় লিখছেন তিনি—এই বোধ কাফকার ভাষিক অন্বেষণের ‘ইহুদিত্ব’কে চরিত্রায়িত করে বলে বেনজামিন মনে করেছেন। আমার বিবেচনায়, বেনজামিন তার বোদলেয়রে দেখেছেন ‘মোটিফ’, কিন্তু কাফকা-পাঠে বেনমাজিনের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে ভাষা ও গল্পের ওপর (বা বলা যায় গল্পহীনতার ওপর)।
গল্প ফুরিয়ে গেছে। ইঙ্গিতটা এসেছে বেনজামিনের কাছ থেকেই। কাফকা-পাঠের ভেতর দিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন যে, পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে নামহীন রূপকথা, যার ভিত্তি ছিল সেই ভাষা যা ঐক্যকে আমন্ত্রণ জানায়, জানায় তা ঐতিহ্যকেও। রূপকথা নেই, গল্প নেই, সেই কারণে নেই মহাকাব্যও। নেই সেই ভাষা যেখানে প্রতীকের অবস্থা সম্ভব। বরং বেনজামিন জানাচ্ছেন যে, এই ‘নেই’ থেকে উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছে। অর্থাৎ উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছে গল্পের ফুরিয়ে যাওয়া থেকে। মহাকাব্যের ধ্রুপদী ঐক্যচেতনা নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকেই আধুনিকতাবাদী উপন্যাসের শুরু। এই কারণেই উপন্যাসের ভাষা শুধু বিচ্ছিন্নতাকেই উৎসাহিত করে না; সে নিজেই থাকে বিচ্ছিন্ন, অনেকটা জর্মন ইহুদির মতোই। বেনজামিন বলেন, কাফকার উপন্যাসে এই অভিজ্ঞতার প্রমাণ মেলে। দ্য কাসল উপন্যাসটিতে আমরা যে ‘K’কে দেখি, তার কোনো গল্প নেই, তার ভাষা দুষ্প্রবেশ্য; এমনকি সে নিজেই অনুপস্থিত, যেমন অনুপস্থিত তার পৃথিবীর কার্যকারণ, তার প্রতিপক্ষও। গল্পের জন্য ‘উপস্থিতি’ জরুরি, কিন্তু ‘অ্যালেগরি’তে দরকার অনুপস্থিতি। ‘অনুপস্থিতি’র ‘অ্যালেগরি’টাই হচ্ছে কাফকার উপন্যাস। কাফকা-পাঠে বেনজামিন তাঁর মার্কসবাদী অবস্থানকে ইঙ্গিতেই চিহ্নিত করেছেন এই বলে যে, আধুনিকতাবাদী পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতার যে সংকট তৈরি হয়েছে সাহিত্যে, তার আলোচনা পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বাইরে সম্ভব নয়। বেনজামিনের মতে, পুঁজিবাদ নিজেই বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে।
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.