ঢালাও তত্ত্ববিরোধিতা প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা বলা দরকার। এই তত্ত্ববিরোধিতা আমাদের একাধিক কবি ও কথাসাহিত্যিকের মধ্যে বেশ চালু আছে, যেমন মধ্যবিত্ত...

ঢালাও তত্ত্ববিরোধিতা প্রসঙ্গে || আজফার হোসেন

9:22 AM Editor 0 Comments

ঢালাও তত্ত্ববিরোধিতা প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা বলা দরকার। এই তত্ত্ববিরোধিতা আমাদের একাধিক কবি ও কথাসাহিত্যিকের মধ্যে বেশ চালু আছে, যেমন মধ্যবিত্ত সমাজের একটি অংশে বিশেষভাবে চালু আছে এই ভীষণ আপত্তিকর ধারণাটা: ‘যারা সবকিছুতেই ব্যর্থ হয়, তারা কবিতা বা গল্প লেখে।’ ‘আর আজকালকার কবিতা? আগামাথা কিছুই বোঝা যায় না?’ দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ওঠে তত্ত্বের বিরুদ্ধে যেমনি, যাকে আলাদা করে সৃজনশীল রচনা বলা হয় তার বিরুদ্ধেও তেমনি। জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়তে অভ্যস্ত হয়ে-ওঠা একজনকে বলতে শুনেছি যে, তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতার আগামাথা ধরতে পারেন না। সম্প্রতি এক বন্ধু আমাকে বলেছেন যে, হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখিকে দারুণ দুর্বোধ্য ঠেকেছে। তাহলে দুর্বোধ্যতার বিষয়টি কি কেবল তত্ত্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? এ প্রশ্নে আমি পরে ফিরব। তার আগে তত্ত্ববিরোধিতা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। যাঁরা মনে করেন যে, ‘সৃষ্টি আগে, তত্ত্ব পরে’, তাঁরা যে কেবল ‘সৃষ্টি’ ও ‘তত্ত্ব’-এর মধ্যে একটি অসম বিভাজন-রেখা এঁকে দিচ্ছেন তাই নয় তাঁরা একই সঙ্গে এক ধরনের সৃষ্টি -তত্ত্ব এবং ‘তত্ত্ব’ ফাঁদছেন। এসবকে একসঙ্গে করে জ্ঞানতত্ত্বও বলা যেতে পারে। যাঁরা এই জ্ঞানতত্ত্ব তাঁদের উচ্চারণে প্রায় অভ্যাসবশত জারি রেখেছেন, তাঁরা আবার ঢালাওভাবে তত্ত্বের বিরোধিতাও করেন এই বুঝিয়ে যে, তত্ত্ব দিয়ে সৃজনশীল রচনা ব্যাখ্যা করা যায় না। লক্ষ্য করুন, এঁরাও একই সঙ্গে সৃজনশীল রচনা নিয়ে এবং ব্যাখ্যা নিয়ে তর্জনী নির্দেশের ভেতর দিয়েই তাঁদের তত্ত্ব জারি রাখছেন। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এক ধরনের কাব্যতত্ত্বও ফাঁদেন এভাবে: ‘রাজনীতি কবিতাক নষ্ট করে।’ কে আগে আসে আর কে পরে, কিংবা কে কাকে কীভাবে ‘নষ্ট’ করে, সে-সব বিষয় অবশ্যই ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। তবে তত্ত্ব থাকেই, থাকে তার ছায়া ও আলো, থাকে তার আভাস ও ইঙ্গিত, আমাদের অনুশীলনের সমগ্রেই। তত্ত্ব-বিরোধিতাও তত্ত্বের জন্ম দেয়। তবে সব তত্ত্বই--সব কবিতা ও সব সমালোচনার মতো--এক ধরনের নয়। কোনো কোনো তত্ত্ব থাকে প্রকাশ্য এবং বিভিন্ন অনুপুঙ্খে ও অনুষঙ্গে উদ্ভাসিত; আবার কোনো তত্ত্ব থাকে আভাসে-ইঙ্গিতে ব্যঞ্জনাময় বা এমনকি ভীষণ প্রচ্ছন্ন। কোনো তত্ত্ব দাঁড়িয়ে যায় মানুষের সৃজনশীলতার ও মুক্তির পক্ষে, আবার কোনো তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের টুঁটি চেপে ধরে কবিতাকে কেবল ‘মেটাফিজিক্স’ বানিয়ে থাকে সিজদা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কোনো তত্ত্ব আবার চুপ থেকে বা না থেকে শাসক শ্রেণীকেই ছাড় দেয় বা এমনকি তার দালালিও করে; আবার কোনো-কোনো তত্ত্ব খেটে-খাওয়া মানুষের লড়াকু হাতিয়ারেই রূপান্তরিত হয়। তাই ঢালাও তত্ত্ববিরোধিতার অন্তর্নিহিত অসঙ্গতিকে প্রশ্ন করার ভেতর দিয়েই ওইসব প্রশ্ন তোলা জরুরি ঠেকে: কার তত্ত্ব? কিসের তত্ত্ব? কোথাকার তত্ত্ব? কী ধরনের তত্ত্ব? কী কাজ করে সেই তত্ত্ব? হ্যাঁ, কবিও হতে পারেন তাত্ত্বিক; হয়েছেনও। আবার একজন তাত্ত্বিকও হতে পারেন কবি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এখানে একটা বড় উদাহরণ। তাঁকে ‘বিপ্লবী’ বলি বা ‘সংস্কারক’ বলি, তাঁর সঙ্গে একমত হই বা না হই, তিনি যে তাঁর অসংখ্যা প্রবন্ধে তত্ত্বের পর তত্ত্ব উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন, তা অবশ্যই বলা যাবে। যেমন: আনন্দ নিয়ে তাঁর তত্ত্ব আছে, ঐক্যচেতনা নিয়ে তাঁর তত্ত্ব আছে, শিক্ষা নিয়ে তাঁর তত্ত্ব আছে, পরিবেশ ও কৃষি নিয়েও আছে তাঁর তত্ত্ব। রবীন্দ্রভক্তদের কেউ কেউ এও জানিয়েছেন যে, তাঁর অনেক কবিতার চেয়েও তাঁর কিছু কিছু তাত্ত্বিক প্রবন্ধ বেশি শক্তিশালী। সেটি বিতর্কের ও বিভাজনের আরেক প্রসঙ্গ। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। তবে যে কথাটাকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনতে চাই, তা হলো: যাঁরা ‘সৃষ্টি’ ও ‘তত্ত্ব’-এর মাঝখানে উঁচু-নিচু সম্পর্ক বহাল রেখে ‘তত্ত্ব’কে ‘সৃষ্টির’ এলাকা থেকে বহিষ্কৃত করে চলেছেন, তাঁরা তত্ত্বের সৃষ্টিশীলতার ইতিহাসের বিরুদ্ধেই জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাস চালিয়ে এক ধরনের তাত্ত্বিক স্বৈরশাসনকেই টিকিয়ে রাখতে চান। নান্দনিকতার নামে যাঁরা পশ্চিমা দুনিয়ায় তত্ত্ববিরোধিতার বুর্জোয়া অনুশীলন অব্যাহত রেখেছেন, তাঁদের নিকটাত্মীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে তারাই, যারা আমাদের দেশে তত্ত্ববিরোধিতা ও রাজনীতিবিরোধিতাকে তথাকথিত ‘সৃজনশীলতা'’র অন্তর্গত করে রেখেছেন সাহিত্যিক এস্টাব্লিশমেন্টের ছত্রছায়ায়। এঁরা তরুণদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকেও বিরোধিতা করেন বা নিমিষেই খারিজ করেন তাঁদের খ্যাতি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে। এদের বস্তা-পচা বুলিতে যেন ‘জার্গন’ নেই, কেবল আছে অন্যদের ভাষাতেই! সমালোচনা ও তত্ত্ব কীভাবে সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে, বা কীভাবে কবিতা নিজেই হয়ে ওঠে দারুণভাবে সমালোচনামূলক ও তাত্ত্বিক, বা কীভাবে পশ্চিমা মুলুকের জ্ঞানভাষ্য-নির্দেশিত বিভিন্ন ‘ডিসিপ্লিন’-এর দেয়াল ও সীমান্তগুলো লড়াকু চিন্তা, বয়ান ও আখ্যানের আঘাতে আঘাতে ভাঙতে থাকে, বা কীভাবে দর্শন-ইতিহাস-অর্থনীতি পরস্পরকে কাছে টেনে জ্ঞানভাষ্যিক সংহতি ও সংঘর্ষ তৈরি করে, সেইসব বিষয়ের আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ না টেনে পারছি না। উদাহরণটা হচ্ছে লড়াকু চিকানো নারীবাদী কবি-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্ট গ্লোরিয়া আনজালদুয়ার _বর্ডারল্যান্ডস/ লা ফ্রানতেরা_। আনজালদুয়া তাঁর এই সৃষ্টিশীল কাজে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, পণ্য-‘ফেটিসিজম’-এর এই যুগে চিন্তাচর্চায় ও জ্ঞানচর্চায় একটির সঙ্গে আরেকটি বিষয়ের বা ঘটনার সম্পর্ক না-ধরার বা মুছে ফেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এমনভাবে যে, কবিতাকে রাখা হচ্ছে একটি খোপে, দর্শনকে আরেকটি খোপে বা সমালোচনাকে রাখা হচ্ছে অন্য আরেক জায়গায়। আনজালদুয়ার মতে, এভাবে বিশ্বব্যাংকের সেক্টরভিত্তিক পর্যালোচনা মার্কা-জ্ঞান/ক্ষমতা-সম্পর্কের আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এই আধিপত্য আমাদের সমালোচনার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে বৈকি, যেমন আছে তার কিছু ব্যতিক্রমও। এবার ফিরে আসি দুর্বোধ্যতা প্রসঙ্গে। একজন সৃষ্টিশীল তাত্ত্বিক বলেছিলেন এভাবে: ‘আমি বুঝি না, তাই তুই শালা ইডিয়ট।’ হ্যাঁ, বিভিন্ন কাজ নিয়েই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছে বৈকি। তাই দুর্বোধ্যতা নিয়ে ঢালাওভাবে কোনো কথা বলা মুশকিল। তবে হয়তো বলা যাবে যে, দুর্বোধ্যতার বিষয়টি পরিপ্রেক্ষিতনির্ভর; দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি করার বা তা নিয়ে অভিযোগ তোলারও মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক অভিক্ষেপ আছে বটে। সে-কারণে বলা যাক, মার্কসের মূল্যতত্ত্ব একজন বিবিএ পাস-করা বহুজাতিক কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দারুণ দুর্বোধ্য ঠেকে; কিন্তু একজন শোষিত শ্রমিক ওই তত্ত্বটা দ্রুত ধরে ফেলে (এ প্রসঙ্গে উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর একটি চমৎকার আলোচনা আছে)।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.