মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঝাঁঝরা চালের দেহতত্ত্ব আজফার হোসেন আরও সূক্ষ্ম আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চাই। --বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিহ্ন...

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঝাঁঝরা চালের দেহতত্ত্ব || আজফার হোসেন

8:49 PM Editor 0 Comments


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঝাঁঝরা চালের দেহতত্ত্ব
আজফার হোসেন
আরও সূক্ষ্ম আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চাই।
--বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

চিহ্ন হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ময়দান
--ভি. এন. ভলোসিনভ

সমকালীন মানিক-আলোচনায় এখনো কেউ কেউ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতেটাকে হাতড়িয়ে বেড়ান ‘বাস্তবতাবাদ’ নামের এক জারি-থাকা জাহিরি বর্গে। এদের তর্জনি নির্দেশে যেন মুহূর্তেই মানিকের পরিচয়টা নির্দিষ্ট হয়ে যায়: ‘মানিক বাস্তবতাবাদের এক অসাধারণ রূপকার।’ তবে এই বৃত্তায়ন কতটুকু মানিককে চিনিয়ে দেয়, তাও আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। কারণ ‘রিয়েলিজম’ বা বাস্তবতাবাদকে শিল্পের সঙ্গে কোনো রৈখিক সম্পর্ক বেঁধে ফেলার ক্ষেত্রে শিল্প নিজেই আর সায় দেয় না। শিল্প নিজেই যেন বলে ওঠে, আমি তো যেতে পারি আরো, বাস্তবতা থেকে বাস্তবতায়, এমনকি কল্পিত বদলানো বাস্তবতায়।

অন্য কথায়, বাস্তবতার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক থাকে তো বটেই, যেমন _দ্যা জার্মান আইডিয়লজি_-তে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর বয়ান মোতাবেক “ভাষা নিজেই বস্তজগতের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে”। আবার কোনো পরিচিত, প্রচলিত, এমনকি নিজের চোখ দিয়ে চট করে দেখে নেওয়ার মতো বাস্তবতার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক হতে পারে বিরোধেরও। এভাবে শিল্প ওই বাস্তবতাকে দুমড়াতে পারে, মোচড়াতে পারে, চ্যাপ্টা করতে পারে, এমনকি বদলাতেও পারে। মানিকের কথাশিল্পের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্কটা মোটামুটি এ ধরনেরই, তার লেখক জীবনের প্রায় শুরু থেকেই।

অর্থাৎ যে কথাটা বোঝাতে চাইছি, তা হলো এই যে, মানিক বাস্তবতার কথা শুধু বলেনই না; না, বাস্তবতাকে শুধু ‘রিপ্রেজেন্ট’ করার বিশ্বস্ত দায়ভার কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাবার জন্য তিনি বোধ করি লেখেন নাই; বাস্তবতাকে বদলাবার দারুণ এক তাগিদও কাজ করেছে তার ভেতরে। ওই তাগিদটা ধরা পড়ে তার ভাষার রাজনীতিতে। জোর দিয়েই বলা দরকার, শিল্পীর বদলানোর কাজটা একজন রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টের বদলানোর কাজের মতো অবশ্যই নয়; তেমন যে হতেই হবে, তাও নয়। শিল্পীর এ কাজটা স্থূল অর্থে উচ্চকিত ও প্রকাশ্য নাও হতে পারে। তবে কাজটা চলতে থাকে ভাষায়, ফর্মে, চিহ্নের আঘাতে আঘাতে এবং সোজা কথায় প্রচলিত বাস্তবতাকে ‘সাবভার্ট’ করার বিভিন্ন আয়োজনে।

সেই বিবেচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তবতার নিছক প্রতিফলক নন। তিনি সেই বাস্তবতাকে বদলাবার জন্য বিভিন্ন সম্ভাবনাকে এমনভাবে পরখ করেন যে, নিছক ‘বাস্তবতাবাদী’র লেবেল এঁটে মানিককে চিহ্নিত করার অর্থ দাঁড়ায় তার সৃজনশীল ও ভাঙনপ্রত্যাশী ভাষিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে রীতিমতো হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতার করা। একে বলা যায়, লেবেলের পুলিশি। বন্ধনিতে বলা দরকার এ ধরনের পুলিশির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তো রাজনৈতিকভাবে লিপ্ত ফিলিস্তিনি কবি রশীদ হোসেন একবার বলেছিলেন, “একশজন রাজনীতিকের একশটি টগবগ-করা বক্তৃতার চেয়ে মাত্র একটি গর্জে-ওঠা কবিতা মানুষকে বেশি নাড়া দিতে পারে। সেজন্য অবশ্য কবিতার মতো কবিতা চাই”।

লেবেলের যে পুলিশির কথা বলা হলো, তার একাধিক প্রকাশই লক্ষ্য করা যাবে সনাতন মানিক সমালোচনায়। যেমন ‘মার্কসবাদী’ নন্দনতত্ত্বের দোহাই পেড়ে (অবশ্যই বলতে হবে যে, মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক পালাবদল ঘটে গেছে ও তার সম্ভাবনাও সম্প্রসারিত হচ্ছে, যার সাক্ষ্য বহন করছে সাম্প্রতিক সাহিত্যতত্ত্বের আন্দোলনগুলো। কিন্তু আমাদের এখানে ‘মার্কসবাদ’-এর নামে নন্দনতত্ত্বের সীমিত ফর্মুলামাফিক চর্চা ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতে বাজতে এখন তা ফসিলে রূপান্তরিত হয়েছে।) সোশ্যাল রিয়েলিজম বা সামাজিক বাস্তবতার গন্ধ শোঁকার প্রচলিত অভ্যেসে মানিকের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা এখনো ঘটছে। ভাবটা এমন যে, মানিক গলির ধারের ‘আল্পনা স্টুডিও’র বা ‘রিয়েলিজম স্টুডিও’র ভাড়া-খাটা ক্যামেরাম্যান—শুধু ক্লিক করলেই হলো, অবিকল ছবিটা ঠিকই তোলা হয়ে যাবে।

কিন্তু না, কেবল ছবি তোলার কাজটা তিনি নেননি; তিনি ছবি নির্মাণ করেন, তাকে ভেঙে ও ছিঁড়ে ফেলেন; আবার যা লুকিয়ে থাকে, তারও ছবি তোলেন। আবার যার ছবি তোলেন, তাকে বদলিয়েও তুলে আনেন। মানিকের এই স্বভাবটা মরচে-পড়া সাহিত্যতত্ত্বের ‘প্রতিফলন মডেল’-এর সঙ্গে খাপ খায় না। মানিকের “গল্প লেখার গল্প”-এর সূত্র ধরে কেউ কেউ এও বলে থাকেন যে, মানিক সোভিয়েত সামাজিক বাস্তবতাবাদী উপন্যাস ও গল্প পড়েছেন প্রচুর, একেবারে ছেলেবেলা থেকেই। তা পড়েছেন বৈকি, তবে বাস্তবতা প্রতিফলনের কোনো ফর্মুলা রপ্ত করার জন্য নয়।

১৯৩৬ সালে প্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সবচেয়ে সাড়া-জাগানো তিনটি উপন্যাস—_পুতুলনাচের ইতিকথা_য়, _পদ্মা নদীর মাঝি_তে এবং _জীবনের জটিলতা_য়—বাস্তবতা কী কেবলই প্রতিফলিত? _পুতুল নাচের ইতিকথা_র সেই গাউদিয়া গ্রাম কেবলই কী বাস্তব ছবি? মানিকের ‘পদ্মা’ কী কেবলই নদী, কেবলই কী সে কেতপুর গ্রাম আর পূর্বদিকের জেলে পাড়ার সঙ্গে সম্পর্কে ঘুরপাক খায়? _জীবনের জটিলতা_ উপন্যাসটিতে আমরা কেবলই কি প্রত্যক্ষ করি উপন্যাসের ক্যামেরা দিয়ে তোলা মাধ্যবিত্ত জীবনের প্রেমের জটিলতা, বেকারত্ব আর দারিদ্রের জ্বালার ছবি, যেখানে বাস্তবতা অবিকল প্রতিফলিত? আর প্রতিফলন বিষয়টিই বা কি?

উত্তরকাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্বের আবির্ভাবের আগেই মার্কসবাদী সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ওয়ালটার বেনজামিন আওয়াজ তুলেছিলেন ওই প্রতিফলন প্রসঙ্গেই; বলেছিলেন যে, বিশুদ্ধ প্রতিফলন বলে বিছু নেই, তবে বস্তুজগতের সঙ্গে চৈতন্যের মধ্যস্থতাকারী ভাষা বাস্তবতাকে প্রতিসরিত করে, বিকিরিত করে, এভাবেই তাকে প্রকাশ করে। এই প্রকাশই মানিকের বাস্তবতাবোধে আমরা লক্ষ্য করি। এও খেয়াল করা দরকার যে, মানিকের ভাষার রাজনীতিতে বাস্তবতা কেবল বিকিরিতই নয়, তা রূপান্তরিতও বটে। তাই ‘পদ্মা’ আমাদের প্রচলিত বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে ছুটে চলে আরো তীব্রতায়, মাঝিও নদী বদলাতে থাকে, যেমন গাওদিয়া গ্রাম শুধু গ্রাম থাকে না, সে হয়ে ওঠে কখনো গ্রাস, কখনো আশ্রয়।

অর্থাৎ শুধু বলাতেই নয়, বদলাতেও মানিকের আগ্রহ অনেক। তার ওইসব উপন্যাস লেখার সঙ্গে সঙ্গে মানিক বদলাবার চেতনাকে জ্বলজ্বল করে দীপ্তিমান রাখেন নিজস্ব উচ্চারণে, যে-উচ্চারণ স্বীকারোক্তিও বটে: “নিত্যনতুন আবিষ্কারে বিজ্ঞান বদলিয়ে দিয়ে চলে সমাজ ও জীবনকে, বদলে দিয়ে চলে মানুষের চেতনাকে। এই চেতনায় জাগে সাহিত্যের কাছে নতুন চাহিদা”। সত্য, গত শতকের চল্লিশের দশকে মার্কসবাদে সাক্ষাৎ দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন মানিক। এও সত্য যে, মার্কসবাদ মানিকের বদলাবার চেতনাকে ধারালো করেছে। মানিক নিজেই বলেছেন, “আমার লেখায় যে অনেক ভুল, ভ্রান্তি, মিথ্যা, অসম্পূর্নতার ফাঁকি আছে আগেও আমি তা জানতাম। কিন্তু মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে এতটা স্পষ্ট ও আন্তরিকভাবে জানবার সাধ্য হয়নি। [...] মার্কসবাদই যখন মানবতাকে প্রকৃত অগ্রগতির সঠিক পথ বাতলাতে পারে, অতীতে কি ছিল, বর্তমানে কি হয়েছে এবং কিভাবে কোন ভবিষ্যৎ আসবে জানিয়ে দিতে পারে, তখন মার্কসবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে সাহিত্য করতে গেলে এলোমেলো উলটোপাল্টা অনেক কিছু তো ঘটবেই”। কিন্তু চল্লিশের দশকের আগেও বদলাবার তাগিদটা লক্ষ্য করা যায় মানিকে বিভিন্নভাবেই। একেবারে তিরিশের দশকের শুরুটাকেই তো চিহ্নিত করা যায়। এমনকি মানিকের নিজস্ব, তুলনামূলকভাবে কাঁচা কাব্যপঙক্তিতেও সেই তাগিদটা ধরা পড়ে: “দিবানিশি মৃত্যু চায় জীবনে সমস্ত শত্রুর”। কিন্তু কীভাবে?

বলা দরকার, এখানে মানিকের কোনো জীবনালেখ্য হাজির করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কাজটি এর মধ্যে অনেকেই করেছেন। অবশ্যই মানিক বাংলা সাহিত্যের একজন ‘ক্যানোনিক্যাল’ লেখক—প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত, বিদ্যায়তনিক পাঠ্যক্রমে বিশেষভাবে উদযাপিতও বটে। তাঁর কাজ ও অবদানের সামগ্রিক মূল্যায়নের চেষ্টাও করেছেন অনেকেই। বর্তমান রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর কাজের সামগ্রিক মূল্যায়ন একইসঙ্গে আমার সাধ ও সাধ্যের বাইরেও। তবে আমি মানিকের একটি ছোট গল্পকে পাঠ করার সুযোগ নেব, যে গল্পকে আমার কাছে একাধিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে। গল্পটির নাম ‘আত্মহত্যার অধিকার’। আমি আমার পুনর্পাঠের অভিমুখ খানিকটা শনাক্ত করার স্বার্থেই গল্পটির একটি উপশিরোনাম এখানেই জুড়ে দিচ্ছি: ‘বদলাবার অধিকার’।

‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পটি রচিত হয়েছে মানিকের লেখক জীবনের প্রায় শুরুতেই। ‘অতসীমামী’ মানিকের প্রথম প্রকাশিত গল্প এবং প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৯২৮ সালে (বাংলা সাল ১৩৩৫)। বিচিত্রা পত্রিকায় এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখেই গল্পটি লিখে ফেলেছিলেন মানিক। সেই তার লেখক জীবনের শুরু ওই গল্প দিয়েই। এরপর সাত বছরের ব্যবধানে মানিকের প্রথম উপন্যাস _জননী_ প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প-সংকলন _অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প_। এই সংকলনের মোট দশটি গল্পের মধ্যে ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পটি শেষ গল্প, যা পরবর্তী সময়ে মানিকের একটি শ্রেষ্ঠ গল্প হিসেবে বিবেচিত, পঠিত ও সমালোচিত হয়েছে। সত্য, এই গল্পে সম্পূর্ণ মানিককে অবশ্যই ধরা যাবে না। তবে ‘সম্পূর্ণ মানিক’ হয়ে-ওঠার খানিকটা দ্যুতি গল্পটিতে হয়তো পাওয়া সম্ভব—সেই মানিক যিনি বদলাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এবার ফেরা যাক গল্পের দিকে।


গল্পের শুরুতে ঝিকমিক করে ওঠে একটা নির্মেদ, নির্ভার, ধনুকের ছিলার মতো টানটান বাক্য: “বর্ষাকালেই ভয়ানক কষ্ট হয়”।

লক্ষণীয় যে, বর্ষাকালকে জোরেশোরে সামনে আনার পক্ষে ‘ই’ প্রত্যয়ের নির্ভেজাল ওকালতি চলছে। সেই সূত্র ধরে গল্পের ভেতরে ঢুকেই দেখতে শুরু করি যে, এতো বর্ষার গল্প। মানিক আসলে নিজেই বলে দিচ্ছেন ওই এক বাক্যের স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অনুচ্ছেদে যে, তিনি একটি বর্ষার গল্প বলছেন। এখানে বৃষ্টি থাকবে, প্রচণ্ড বৃষ্টি, জরুরি অবস্থার মতো দাবড়িয়ে-নেওয়া বৃষ্টি। এখানে “ঘরের চাল” থাকবে বটে, তবে সে চাল ওই বৃষ্টিকেই ‘ই’ প্রত্যয়ের ওকালতিতে নিমিষেই জায়গা করে দেবে। আমরা গল্পের দ্বিতীয় বাক্যে (বাক্যটি এবারো নিজেই একটি গোটা অনুচ্ছেদ) যে কথাটি শুনি, তাও নির্মেদ কিন্তু নিষ্ঠুরভাবেই তীব্র, স্পষ্ট: “ঘরের চালাটি একেবারে ঝাঁঝরা হইয়া গিয়াছে”। “ঝাঁঝরা” শব্দটির প্রচণ্ড ঝাঁঝ ওই বৃষ্টির গল্পকেই ঘোষনা করে। না, এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই; রহস্যময়তার কোনো মালার্মীয় কাব্য নেই এখানে। বরং বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্ব যে ধরনের রহস্যময়তার ঘোরের ওপর তার অভিজাত শ্বাসাঘাতকে প্রয়োগ করে, সে ধরনের ঘোরের পোঁদে যেন ছয় পায়ে কষে লাথি মেরেছে ওই বাক্যটা।

মানিকের আগে ও পরে বর্ষা নিয়ে আমরা অনেক কবিতা ও গল্প পেয়েছি। সেই বিদ্যাপতির “ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্ততি/ ভুবন ভরি বারিখন্তিতা/ কান্ত পাহুন কাম দারুণ/ সখনে খরখর হন্তিয়া.../ মত্তদাদুরী ডাকে ডাহুক-/ ফাটি যাওত ছাতিয়া” পঙ্ক্তিগুলো থেকে শুরু করে ডি এইচ লরেন্সের খপ্পরে-পড়া বুদ্ধদেব বসুর _রাতভরে বৃষ্টি_ উপন্যাসের ভেতর দিয়ে ডিলান টমাসের পেশি-ফোলানো শহীদ কাদরীর বৃষ্টি-বিষয়ক কবিতা পর্যন্ত পঙ্ক্তির আর বাক্যের বর্ষণে-বর্ষণে আমরা বর্ষা নিয়ে বন্দনা পাই, উচ্ছ্বাস পাই, ভাবাবেগ পাই, রোমান্টিকতা পাই এবং ক্ষেত্র বিশেষে কিছু অবিস্মরণীয় শিল্পিত চিত্রকল্প ও সাঙ্গীতিকতা পাই বটে। মানিকও ওই বর্ষা নিয়েই গল্প ফাঁদলেন; কিন্তু বর্ষার প্রাক্তন ও প্রচলিত আবহকে তিনি উল্টিয়ে দিয়ে নিজের মতো ঠিকঠাক করে নিলেন। একদিকে তীব্র বাস্তবতা, ঝাঁঝালো ও স্পষ্ট বাস্তবতা; অন্যদিকে সেই বাস্তবতার রূপান্তর, “ভয়ানক কষ্টের”র ভেতর দিয়েই।

কিন্তু কার কষ্ট? এরা কারা? গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের অচেনা ও অজানা নয়। এরা রোদে পুড়ে-পুড়ে তামাটে কিংবা ছাই হয়; এরা মাঝরাতে সংসারসমেত ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পরের বাড়ির বৈঠকখানার স্যাঁতসেতে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে আর অনুভব করে “বাঁচিয়া থাকাটা আজ নয় বরং কাল নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন”। হ্যাঁ, এদের বর্ষারাতের, ঝাঁঝরা চালের “ভয়ানক কষ্টের” গল্পই হচ্ছে ‘আত্মহত্যার অধিকার’। এরা হচ্ছে একই সংসারের, একই বর্ষারাতের, একই ঝাঁঝরা চালের নিচের ভিন্ন ভিন্ন মানুষ: নীলমণি, নিভা, শ্যামা ও নিমু। মানুষের সঙ্গে বৃষ্টি-ভেজা, দরজা-আঁচড়ানো, ন্যাতানো একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকেও ঘরের ভেতরে ও বাইরে রেখে দিয়েছেন মানিক। আবার অন্য ঘরের চালের নিচে—সে চাল মোটেই ঝাঁঝরা নয়—আরেকজনকে দেখি। এই চালের জন্য জমে উঠতে পারে অন্য স্বরে বর্ষারাতের আরেক গল্প, যে গল্পে কুকুরও লেপের নিচে তার প্রভুর সঙ্গে বৃষ্টির মহাকাব্যের সর্গ থেকে সর্গে ছন্দিত শ্লোক শোনার আনন্দে মশগুল। এই ধরনের গল্পের সহোদর হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর একটি বৃষ্টি-গদগদ আখ্যান মনে পড়ে: “কী ঘন সমারোহেই না বর্ষা নামত সেই নির্জন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। সারা আকাশ মেঘে মেঘে নিবিড়—স্তরের পর স্তর, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, গাঢ় নীল; কখনো দিগন্ত থেকে যেন মেঘের স্তম্ভ উঠে আকাশ বিদীর্ণ করে দিতো [...] বৃষ্টি! বৃষ্টি! [...] চালের ওপর বৃষ্টির অবিরাম গান—সে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি কত রাত্রে”। আহ, বুদ্ধদেব বসু! আপনার শিষ্যরাও আসলে ঘুমাতেই মজা পান।

কিন্তু কেউ ঘুমায়, কেউ জেগে থাকে। চালের ওপর কোথাও বর্ষণের সঙ্গীত, কোথাও মানুষ-তাক-করা বর্ষণের বুলেট। তাহলে ভলোসিনভের চিহ্নের মতোই বৃষ্টিও শ্রেণী সংগ্রামের এলাকা বটে। এবং অবশ্যই ‘চাল’—ভাতের ‘চাল’ও ঘরের ‘চাল’ উভয়েই—হয়ে উঠে শ্রেণীসংগ্রামের ময়দান। এই কথাটি বৃষ্টির শব্দে শব্দেই আমরা শুনতে থাকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পটিতে।



আটচল্লিশ বছর বয়সে প্রাণত্যাগ করেও (জন্মেছেন ১৯০৮ সালের ১৯ মে; মৃত্যু ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর) অসংখ্য কাজ রেখে গেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। চল্লিশটির মতো উপন্যাস লিখছেন তিনি; তার গল্পের সংখ্যা ১৯২ ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। ছোটদের জন্যও গল্প লিখেছেন, যার সখ্যা ২০ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া তার মৃত্যুর পরেও প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু কাজ—গল্প-উপন্যাস-কবিতা। এমনকি কিছু কিছু অসমাপ্ত-অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসের খসড়াও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও ছড়ানো রয়েছে তাঁর রচনা। এছাড়া ‘নন-ফিকশান’ গদ্যও লিখেছেন তিনি; সত্তরের দশকে—অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর দু-দশক পরে—তাঁর ডায়েরি, চিঠিপত্র ও অন্যান্য ব্যক্তিগত লেখার একটি পূর্নাঙ্গ ও প্রামাণিক সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। একটি নাটকও রচনা করেছিলেন তিনি। মৃগীরোগ বা ‘এপিলেপসি’ নিয়ে তাঁর একটি ইংরেজিতে লেখা ‘নোটস’-এরও সন্ধান পাওয়া যায়।

অর্থাৎ কেবল সংখ্যার নিরিখেই বিবেচনা করলে বলতে হয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে বিস্তৃত পরিসর জুড়েই অবস্থান করেন। সেই পরিসরের মানিককে উদ্ধার করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ: তাঁর তাৎক্ষণিক চরিত্রায়নও সে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। আগেই বলেছি, বর্তমান রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো সামগ্রিক চরিত্রায়ন ও মূল্যায়ন আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে তাঁর একটি গল্পের পাঠ এখানে ইতিমধ্যেই প্রস্তাবিত হয়েছে। এই গল্পে বাস্তবতার সঙ্গে মানিকীয় ভাষিক রাজনীতি এবং তার বদলাবার তাগিদটাকেও খানিকটা পড়া সম্ভব হবে, অন্যান্য চিহ্ন-পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই।

তাহলে আবারো ফেরা যাক ‘আত্মহত্যার অধিকার’-এ।



আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, রাখঢাক না রেখেই “ভয়ানক কষ্ট” চিহ্নায়ক জোড়া ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পটির ভরকেন্দ্র তৈরি করেছে গল্পের একেবারে শুরুতেই। এভাবে শুরুতেই ভরকেন্দ্র তৈরি করায় মনোযোগ নাও দিতে পারতেন মানিক; ধরে রেখে রেখে অগ্রসর হতে পারতেন, যেভাবে ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স ও টমাস হার্ডি অগ্রসর হয়েছেন, এমনকি ফরাসি বাস্তবতাবাদী ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লোবেয়ারও অগ্রসর হয়েছেন মাঝে মধ্যে। মানিক আসলে ওই তিরিশের দশকেই বলার একটা ঢঙ আবিষ্কার করেছিলেন, যেমন ওই ‘আত্মহত্যার অধিকার’ নামক গল্পটিতেই।

লক্ষণীয় যে, গল্পটা আগে বলে দিলেও আমরা কিন্তু পরে ওই গল্প শোনা থেকে মোটেই বিরত থাকি না। এখানেই এক ধরনের ভাষিক রাজনীতি ক্রিয়াশীল হতে থাকে এই অর্থে যে, বলে দেওয়া গল্পের পরের অংশে বদলাবার চিহ্নও থাকে (মানিকের একটা আস্ত উপন্যাস আছে, যার শিরোনামই _চিহ্ন_, যেখানে আমরা লক্ষ্য করি প্রথমে বলার ও পরে বদলাবার প্রায় অনুরূপ চিহ্নগুলো)—ভাষার একটা স্পেস-দখল চলতে থাকে, যার ভেতর দিয়েই লক্ষ্য করি যে, জীবন যন্ত্রণার চাপে বাক্যের, চিত্রের, ধ্বনির সামঞ্জস্য আরো অটুট হয়ে ওঠে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে এক কঠিন প্রতিরোধ গড়ে উঠে প্রথমে ভাষাতেই।

গল্পে লক্ষ্য করি যে, ভীষণ বৃষ্টির রাতে কাতর ও উপদ্রুত, প্রায় তছনছ-হয়ে-যাওয়া সংসারের ভেতর থেকেই নীলমণি তার স্ত্রী নিভার ওই প্রশ্ন “ওরই কী শেষে নিমুনিয়া হবে?”-এর উত্তরে বলে ওঠে “হয়তো হবে। বাঁচবে”। দারুণ দুর্দিনেও ওই পরিমিত কিন্তু শক্ত উচ্চারণ কারুর কারুর কাছে নিছক অভ্যেসের মনে হলে হতেও পারে। নিঃসন্দেহে নীলমণি ও নিভার জীবন ও জবানের ওপর চেপে-থাকা বর্ষণ নামের বুলেটে ঝাঁঝরা-হয়ে-যাওয়া বাস্তবতা তাদের ভাষাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে। তারপরও ভাষা ও দেহ একাকার হয়ে কথা বলে ওঠে ওই বৃষ্টির বুলেটের বিপরীতে ও বিরুদ্ধে: “বাঁচবে”। হ্যাঁ, বাঁচবে। বেঁচে যায় ঠিকই, মরে গিয়েও। উইলিয়াম ফকনারের সেই বিখ্যাত উচ্চারণটা মনে আসে—"ম্যান উইল প্রিভেইল”—যদিও প্রতি মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাওয়ার আতঙ্কটা থেকেই যায়, কিংবা প্রতি মুহূর্তেই বাঁচাটাকে নিষ্প্রয়োজন মনে হয়।

গল্পের আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করলে আমরা একজন মাকে দেখতে পাই: সে হচ্ছে নিভা। বর্ষারাতে ঝাঁঝরা চাল ও ভাঙা বেড়ার বাড়িতে ‘স্ত্রী’ হিসেবে ‘নিভা’ নিভে থাকলেও ‘মা’ হিসেবে সে নেভে না মোটেই; ঘুমিয়ে থাকা পুত্র নিমুকে বৃষ্টির আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য তার কোনো চেষ্টার শেষ নেই—একেবারেই নেই। বৃষ্টির আঘাতে এই ভাঙা বাড়িতে প্রায় আশ্রয়হীন সংসারের সকলেই যেখানে জীবনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুদ্ধ চালাচ্ছে ঘুমকে বিদায় দিয়েই, সেখানে ঘরের কোনে গুটিয়ে রাখা বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ঘুমায় শুধু নিমু—নীলমণির “ওইটুকু ছেলে”। এখানে অপরাজিত মাতৃত্ব নিমুকে বাঁচিয়ে রখেছে খানিকটা, সেটা সত্য। কিন্তু এমনকি ওমনি এক বৃষ্টির রাতেও কাবু হয়ে যাওয়া পুরুষগুলোও পুরুষতন্ত্রের পেশি ফোলাবার সুযোগ ছাড়ে না। পুরুষদের লেখা উপন্যাসেই বারবারই দেখা গেছে যে, বাস্তবতার চরম আঘাতের মুহূর্তেই পুরুষতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সংকট পুরুষের শরীরের রগের মতোই ঠেলে বেরিয়ে আসে। মানিক সেটাও খানিকটা দেখিয়েছেন বটে। লক্ষণীয় যে, বর্ষারাতের ঝাঁঝরা চালের নিচে চোখ খুলে জেগে থাকা নিভার মাতৃত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নীলমণির রাগ হয়। সে তার কন্যা শ্যামাকে বলে, “নিমুকে তুলে দে তো শ্যামা”। কিন্তু নিভা প্রতিবাদ করে বলে, “ঘুমুচ্ছে ঘুমাক”। এরপর নীলমণি বলে, “ঘুমুচ্ছে না ছাই। ইয়ার্কি দিচ্ছে। ঢং করছে”। খানিকটা ক্রোধ, খানিকটা বিদ্রূপ এখানে ধরা পড়ে নীলমণির কণ্ঠস্বরে।

কিন্তু নীলমণির ওই বোধ নাটকীয় নয়, ভাবাবেগতাড়িত নয়। এই বোধ উঠে এসেছে পরাজয় ও অক্ষমতার অনুভব থেকে, এক অসহনীয় অথচ সহনীয় বাস্তবতার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেও। শ্রমিক শ্রেণীর ক্রোধ বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আছে বিশ শতকের একাধিক কালো লেখকের; বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যাবে আমিরি বারাকা, অড্রে লর্ড এবং টোনি মরিসনের কথা। তাঁদের ধারণাকে একসঙ্গে করে এভাবে বলা যাবেঃ শ্রমিকের দেহ সমাজের তাবৎ তিক্ততাকে ধারণ করে; সমাজের বিরাজমান অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের জালে আটকে-থাকা শ্রমিকের ক্রোধ অবদমিত হয়; আর সেই ক্রোধ লক্ষ্যবস্তুচ্যুত হয়ে পরাজয়ের গ্লানিকে ঢাকার জন্যই বেরিয়ে আসে তার পুরুষতান্ত্রিক সংসারেই। বলাই বাহুল্য, এই ক্রোধের প্রকাশে শ্রমিকের কোনো মুক্তি নেই। আর নারী, যে একটি নয় একাধিক স্তরেই শোষিত ও নির্যাতিত শ্রমিক, ওই ক্রোধের শিকার হয়ে শ্রেণীর সঙ্গে লিঙ্গের সম্পর্ককেও দেখিয়ে দেয়। এই বিষয়গুলোই একটু মনযোগী ও সচেতন পাঠে বেরিয়ে আসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পটি থেকেই।

কিন্তু এসব বিষয়, বোধ ও অভিজ্ঞতার কোনোটাকেও আবার সম্পূর্ণ স্থির করে ফেলতে চান না মানিক। তবে যে বিষয়টি তিনি গল্পে রেখে যেতে চান, সেটা হলো এই যে, গল্পে মানুষের কোনো চূড়ান্ত পরাজয় নেই, যেমন নেই চূড়ান্ত বিজয়ও। গল্পের শেষে বর্ষারাতের এপিক অভিযাত্রায় অবতীর্ণ হয়ে নীলমণির পরিবার ভাঙা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ঠিকই, একটা “আশ্রয়” পায় ঠিকই “সরকারদের বৈঠকখানায়,” কিন্তু প্রশ্নটাও ঝুলে থাকে ঠিকই: “জগতে কোট কোটি মানুষ যখন উষ্ণ শয্যায় গাঢ় সুখে পাশ ফিরিয়া পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিতেছে—সপরিবারে অক্ষম দেহটি টানিয়া টানিয়া সে তখন চলিয়াছে কোথায়?”

বলাই বাহুল্য, এখানে মানিকের গল্পে ঘরের ঝাঁঝরা চালের মতোই দেহ নিজেই শ্রেণীসংগ্রামের একেবারে মোক্ষম, বস্তুক, দৃষ্টিগ্রাহ্য এলাকা হয়ে চিহ্নিত থাকে। অবশ্যই বলা যাবে যে, যেখানে শ্রমিকের বা খেটে খাওয়া মানুষের দেহ নেই, সেখানে তাদের শ্রেণী সংগ্রামও নেই। শ্রেণী সংগ্রামের এক ধরনের দেহতত্ত্বকেও খানিকটা সামনে আনেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার প্রায় সব কাজেই। এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে মানিকের সঙ্গে আফ্রিকার কালো মার্কসবাদী ঔপন্যাসিক-গল্পকার-নাট্যকার-তাত্ত্বিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর তুলনা যুৎসহই ঠেকে। নগুগি বয়সে মানিকের চেয়ে বেশ ছোট। মানিকের কাজের সঙেগ্ নগুগি পরিচিত নন। তবুও আমি যখন প্রথম নগুগির ‘দ্য রিটার্ন’ নামের গল্পটি পড়ি, তখন মনে হয়েছিল যে, নগুগি যেন মানিককে টুকে দিয়েছেন।

আবারো ফিরে আসি নীলমনির ওই দেহজ, দেহতাত্ত্বিক, শ্রেণী-সংগ্রাম-জাগানিয়া প্রশ্নে। রাতে ভিজে ভিজেই ওই প্রশ্নটা জেগে থাকে নীলমণির দেহের মতোই এবং দেহের ভেতরেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই প্রশ্নটি পরিচিত বাস্তবতাকে যেমন নির্দেশ করে, তেমনি একটা রূপান্তরিত বাস্তবতার চেহারাকেও সামনে আনে এই অর্থে যে, নীলমণির প্রশ্ন তৈরি হওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে; ‘সরকারের’ সঙ্গে ‘নীলমণি’দের শ্রেণী-অবস্থানগত যে পার্থক্য থেকেই যায়, তারও স্বচ্ছ সচেতনতার মুহূর্ত তৈরি হয়েছে এই গল্পে। গল্পে আসলেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার ফলে প্রচলিত ও পরিচিত বাস্তবতাকে ‘সাবভার্ট’ করা সম্ভব হয়েছে। এ রীতিটা স্পষ্টত মানিকীয়, যা তিরিশের দশক থেকেই রপ্ত করা শুরু করেছিলন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

গল্পে একাধিক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই বাস্তবতা রূপান্তরিত হতে থাকে; সে দ্বন্দ্ব ঝাঁঝরা চালের সঙ্গে সরকারদের ছাদের, সে দ্বন্দ্ব ঘুমের সঙ্গে জাগরণের, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষেরও, যদিও প্রকৃতি কেবল প্রাকৃতিকই নয়, তা সামাজিকও বটে। যেমন যে বর্ষারাতে ভিজতে থাকে সংসারসমেত নীলমণি, সেই বর্ষারাত কেবল প্রকৃতির বা ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়, তা সমাজেরই সৃষ্টি বটে।

গল্পে আরো দেখি প্রেমের সঙ্গে ঘৃণার এবং সর্বোপরি জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর দ্বন্দ্ব। লক্ষণীয় যে, গল্পের একেবারে শেষে মানিকের ভাষিক রাজনীতি এক তাৎপর্যপূর্ণ অবয়ব ও আয়তন লাভ করে, যখন মানিক বলেন: “আলোটি নিবিয়া যাওযার আগে নীলমণি বাকি তামাকটুকু সাজিয়া লইল। তরপর ঠেসে দিয়ে আরাম করিয়া পিসের শ্বাস টানার মতো সাঁ সাঁ করিয়া জলহীন হুঁকার তামাক টানিতে লাগিল”। হ্যাঁ, সাঁ সাঁ ধ্বনিটা একই সঙ্গে নীলমণির ও পিসের শ্বাস টানার ধ্বনিকেই নির্দেশ করে।

তবে নীলমণি যেখানে ক্ষণিক আশ্রয়ের আনন্দে আরামে কিছুটা শ্বাস টানে, সেখানে পিসে বড় কষ্টে হাপরের মতো শ্বাস টানে। অর্থাৎ একজন একটু একটু করে জীবনের দিকে ফিরে আসতে শুরু করে, অন্যজন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এই বৈপরীত্য একই মুহূর্তে প্রতিবিম্বিত করার ভেতর দিয়ে মানিক জীবনকে নিযে যেমন মানবতাবাদী রেটোরিকের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে নারাজ, তেমনি মৃত্যুকে নিয়ে কোনো রোমান্টিক ভাবাবেগ বা ছিচকাঁদুনে সেন্টিমেন্টকে তিনি প্রশ্রয় দেন না। আসলে কোনো ভাবাবেগ ছাড়াই ‘আত্মহত্যার অধিকার’গল্পটিতে জীবন ও মৃত্যু উভয়ে উভয়কে যুদ্ধে কাবু করতে থাকে। আমরা দেখি, হাজার আঘাতেও কেউ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে না, আবার কেউ আঘাতে আঘাতে পুরো জেগেও ওঠে না। এই বাস্তবতা প্রতিসরণ ও রূপান্তর উভয়কেই নির্দেশ করে। আবার তা একটা বদলে যাওয়া ছবিকেও সামনে আনে। সে ছবি জীবন ও মৃত্যুর উভয়েরই।

আর হ্যাঁ, ওই সংবাদটিও রেখে যায় মানিকের গল্পটি: সেটা হলো মানিকের গল্পের প্রায় তিন ঘণ্টার জীবনে মানিক নিজ হাতে প্রতি মুহূর্তেই দেবদাসকে খুন করেছেন অবলীলায়। দেবদাসের রক্ত গল্পের প্রতিিট বাক্যের, প্রতিটি চিহ্নের গায়েই তো লেগে আছে।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.