বিশ্বায়ন, মালটিকালচার, মুক্তবাণিজ্য গ্লোবালাইজেশন ও এক মেক্সিকান কার্টুনিস্ট আজফার হোসেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নামের পত্রিকাটা উপহার দ...

গ্লোবালাইজেশন ও এক মেক্সিকান কার্টুনিস্ট - আজফার হোসেন

11:43 AM Editor 0 Comments

বিশ্বায়ন, মালটিকালচার, মুক্তবাণিজ্য
গ্লোবালাইজেশন ও এক মেক্সিকান কার্টুনিস্ট
আজফার হোসেন

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নামের পত্রিকাটা উপহার দিচ্ছে ছবির পর ছবি।ছবির সঙ্গে থাকছে কথাও।

এমনি কতোগুলো কথাঃ এক পাঞ্জাবি-পরা মার্কিন ট্যুরিস্ট নয়াদিল্লির এক পানশালায় সময় কাটাচ্ছেন; ক্ষুধার্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে তিনি পাচ্ছেন লেবাননের খাবার। খাবার যখন খাচ্ছেন, একই সঙ্গে শুনছেন ফিলিপাইনি ব্যান্ডের সঙ্গীত। যখন আবার সঙ্গীত শুনছেন, একই সঙ্গে দেখছেন কীভাবে ওই পানশালায় আইরিশ পানীয়ের বোতলগুলো থরেথরে সাজানো আছে। যখন তিনি এই আইরিশ পানীয়তে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন, তার চোখ গিয়ে পড়ছে জিন্স-পরা এক ভারতীয় তরুণীর ওপর।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওই মুহূর্তটাকে বিশ্বায়নের 'মালটিকালচারাল' মুহূর্ত হিসাবে বিবেচনা করে ইতোমধ্যে তাকে চিত্রকল্পময় উৎসবে রূপান্তরিত করেছে।

কিন্তু ওই কার্টুনিস্ট (যার নাম পরে বলব) বলছেন, "ছবি শুধু দেখায় না, তা লুকিয়ে ফেলার কাজটাও সারে"। তাহলে কী লুকায় সে?

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর আঁকা ওই 'মালটিকালচারাল' মুহূর্তটা উৎপাদন করতে গিয়ে অজস্র মানুষের যে ঘাম ও রক্ত ঝরেছে, তাদের চিহ্নই লুকিয়ে রাখে তাদের ছবিগুলো। কিন্তু ওই কার্টুনিস্ট যা বোঝাতে চাইছেন, তাকে আমি এভাবে বলে নিতে পারিঃ

রক্তের দাগ আসলেই মোছা যায় না; দাগ মোছারও দাগ থেকে যায়।

ফিরি আবারো গ্লোবালাইজেশনে। পশ্চিমা সাহিত্যের একজন অধ্যাপক টেক্সটের চাটনি বানাচ্ছেন। কালো নারীবাদী ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের কাছ থেকে তিনি ঝাল নিচ্ছেন, ফল নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে, মাছ নিচ্ছেন গুয়াতেমালার লেখক ও অ্যাকটিভিষ্ট রিগোবের্তা মেঞ্চুর কাছ থেকে, আর ট্রটস্কির কাছ থেকে নিচ্ছেন ভিনেগার। অধ্যাপক সাহেব এগুলো মিলিয়ে-মিশিয়ে গুলিয়ে খাওয়াবেন তার ছাত্রছাত্রীদেরই, যারা আবার পড়াশুনাকে শুধু “ফান” হিসাবেই নিতে চায়।

আহ, গ্লোবালিজেশন! আপনার অশেষ মর্জি!

এই গ্লোবালিজেশন নিয়ে ওই কার্টুনিস্ট নিজেই একটি রচনা লিখেছেন। সেখানে একটি জায়গায় তিনি বলছেন, "মুক্তবাণিজ্যের বিশ্বায়ন এখন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটাচ্ছে। চীন এখনো সমাজতন্ত্রের তকমা এঁটে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে জোগান দিচ্ছে ক্রীতদাসীয় শ্রম; ভারতের একটি ফার্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কর্পোরেশনের ফর্ম পূরণ করে দিচ্ছে, যে কর্পোরেশন আবার পেরুতে ভদকা বানিয়ে তা বিক্রি করছে পোল্যান্ড থেকে আসা ওইসব মানুষের কাছে, যারা ইংল্যান্ডের টাকায় মাদ্রিদে অট্টালিকা তোলার কাজে হাতে নিয়েছে"।

এতক্ষণ আমি যে কার্টুনিস্টের কথা বলছিলাম, তাঁর নাম এল ফিসগোঁ।
মেক্সিকান। কিন্তু তার আসল নাম রাফায়েল বারাইয়াস দুরান। তিনি তাঁর কাজে ব্যঙ্গ আর প্রতিবাদকে একসঙ্গে চালু রাখেন; প্রথা ও প্রতিষ্ঠানকে তিনি তার কাজে বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ করেন, চ্যালেঞ্জ করেন।


জাতীয় শাসক শ্রেণীর সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যবাদী যোগসাজশকে তিনি রেখায় রেখায় বা আঁকিবুঁকিতেই উন্মোচন করেন অবলীলায়। জাতীয় শাসক শ্রেণীর ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভাড়া-খাটা বুদ্ধিজীবীদের অন্তঃসারশূন্যতাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে’ তাদের তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করেছেন তিনি তার একাধিক কার্টুনে।

নান্দনিকতার ঘোরে মজে-থাকা লেখক ও শিল্পীদের ঔপনিবেশিক মনোগঠন ও জনবিচ্ছিন্নতাকে আঘাতের পর আঘাত হেনেছেন এল ফিসগোঁ তার কাজে।

তিনি মনে করেন, সৌন্দর্যের দোহাই পেড়ে তাদের নান্দনিকতা আবার সৌন্দর্যহীনতার সমস্ত কারণকে প্রছন্ন রাখে; এ "নান্দনিকতা" এভাবে আসলেই সৌন্দর্যবিরোধী। কেননা এই নান্দনিকতা সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ শত্রু হিসাবে পুঁজিকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।

তাই তাদের সুন্দর চিত্রকল্প বা ছবি অতটা সুন্দর নয়, যতটা দেখায়।

এল ফিসগোঁ এও মনে করেন, যিনি শিল্পী, তিনি প্রেমিক; আর যিনি প্রেমিক, তিনি বিদ্রোহীও।


0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.