জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটি এমনভাবে চিহ্নকে ব্যবহার করেছে, যাতে মনে হয়, পঠনে-পঠনে কবিতাটি রং বদলায়। জীবনানন্দ দাশের কবিধর্মকে খানিকটা এ...

জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া' || আজফার হোসেন

5:53 PM Editor 0 Comments

জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটি এমনভাবে চিহ্নকে ব্যবহার করেছে, যাতে মনে হয়, পঠনে-পঠনে কবিতাটি রং বদলায়। জীবনানন্দ দাশের কবিধর্মকে খানিকটা এখানে পাওয়া কষ্টকর ঠেকে না। মনে হয়, ‘ঘোড়া’ ‘সময় চেতনা'র কবিতা। 'এই সময় এক অখণ্ড প্রবহমানতা, দুর্বোধ্য ও তাৎপর্যহীন’, যে কথাটা বলেছেন অলোক সরকার তাঁর এক পাঠে। কিন্তু এও তো বোঝা যায় যে, ‘ঘোড়া’ কবিতাটি প্রথমত ‘ঘোড়া’ নিয়েই লেখা, সে ঘোড়া মহীনের, সে ঘোড়া ঘাস খায়, সে ঘোড়া প্রস্তর যুগেরও, সে ঘোড়া পৃথিবীর ‘কিমাকার ডাইনোমো’র ওপরেও, সে ঘোড়া আস্তাবলেরও। কবি কী তাহলে ঘোড়াকে আটকে ফেলেছেন সম্পর্ক ও অবস্থানের দড়ি দিয়ে? মোটেই না; কেননা দড়িটা কল্পনা করলেও সেই দড়িটা খুলে যায় তখনই, যখনই প্রশ্ন জাগে, অথচ নির্দিষ্ট কোনো উত্তর মেলে না। হ্যাঁ, প্রশ্ন জাগে: মহীন কে? প্রস্তুর যুগ কোনটি? অর্থাৎ আমাদের অতীত কি কোনো শনাক্তযোগ্য, মূর্ত সময়? কিংবা আস্তাবলটাই বা কোথায়? না, নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। অর্থাৎ চিহ্ন থাকে, ভেসে বেড়ায়, এমনকি উড়ে অচিন পাখির মতো। ধরা দেয় না।
কিন্তু তবুও ধরার তাগিদ থাকে। তাই এগোতে থাকে পাঠ এবং কবিতাটি আবারো পড়তে গিয়ে আমরা কবিতার প্রারম্ভিক পঙ্ক্তির আঘাতে মনে করতে থাকি যে, ‘আমরা যাইনি মরে আজো’। কিন্তু এর সঙ্গে ঘোড়ার কী সম্পর্ক? আমরা বুঝে নিচ্ছি যে, আমাদের মরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মরিনি; যা-ই হোক, বেঁচে আছি। এই ‘আমরা’ই বা কারা? এদের সঙ্গে মহীনের ঘোড়ারই বা যোগাযোগ কোথায়? নাকি ‘মহীনের ঘোড়ারাই’ বলে দিচ্ছে কথাটা? সরাসরি উত্তরটা দেওয়া কষ্টকর বটে; এবং এখানে অনুমানের অবকাশও বোধ করি থেকে যায়। কিন্তু যদি বলি, ঘোড়ারা মরে যায়নি আজও, তাহলে কবিতার ভেতরে বিসঙ্গতি কি বেজে উঠবে অশ্রাব্য সুরে?
কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে ‘তবু’ শব্দটি আরেক গোলকধাঁধার ভেতরে আমাদের নিয়ে যায়। ‘তবু’ কেন? আলোক সরকার অবশ্য তাঁর পাঠে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, এই ‘তবু’ শব্দটির ভেতরে নাকি কবিতাটির অন্যতম চাবি লুকিয়ে আছে। তাহলে তো তিনি অচিন পাখিকে ধরে ফেলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে: কবিতার মাত্র একটি চিহ্নে কি কবিতার চাবি গচ্ছিত রাখেন কবি? নাকি প্রতিটি চিহ্নেরই গোপন কোটরায় চাবিটা লুকিয়ে থাকে? যখন কবি ঘোড়ার কথা বলতে বলতে আস্তাবলের কথা বলেন, আস্তাবলের কথা বলতে বলতে আবার ‘বিষণ্ণ খড়’-এর কথা বলেন, তখন আমরা পারম্পর্যশাসিত একটা চিহ্নের পৃথিবীর ঠিকানা তাৎক্ষণিকভাবে হলেও পেয়ে যাই হয়তো। কিন্তু হঠাৎ করে কবি যখন বেড়াল ছানার উপমা ব্যবহার করে চায়ের পেয়ালার কথা বলেন-- ‘চায়ের পেয়ালা কটা বেড়াল ছানার মতো-- ঘুম’, তখন আমরা হেঁচকা টানে আস্তাবল থেকে ঢুকে পড়ি ড্রইংরুমে, রেস্তোরাঁতে (‘রেস্তোরাঁ'র স্পষ্ট উল্লেখ কবিতায় লক্ষণীয়)। পূর্বে গড়ে-ওঠা পারম্পর্য ধাক্কা খায়, ব্যাহত হয় কিংবা ভেঙে পড়ে। কবিতায় এ ধরনের ঘটনা মোটেই নতুন নয়। 'আধুনিকতাবাদী' কবি হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের কবিতায় এ পারম্পর্যহীনতা দেখেছি অজস্রবার।
কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেটা ঘটছে, সেটা হলো এই যে, পারম্পর্যহীনতার চিহ্ন হিসেবে যে ‘তবু’ স্থাপিত হয়েছে কবিতার শুরুতে, সেই ‘তবু’ই বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হয়েছে কবিতার পরবর্তী অংশে। ‘তবু’র একটা পথচলা আছে কবিতায়। অর্থাৎ কবির ইঙ্গিতটা এমন যে, আমরা আছি তবুও ঘোড়া; ঘোড়া বা আস্তবল আছে, তবুও রেস্তরাঁ বা পেয়ালা বা নাগরিক মানুষ বা আমরা। অন্য কথায় বলা যায়, ‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’--অর্থাৎ কেবলই ‘তবু’র জন্ম হয়। চিহ্নের পৃথিবীর কোনো শেষ স্টেশন নেই; কেননা শেষ স্টেশন বলে যা চিহ্নিত হয়, তারপর ‘তবু’ থাকে, অর্থাৎ ‘দৃশ্যের জন্ম হয়’--এ দৃশ্য বা চিহ্ন বোধ করি অন্তহীন। এ-কারণে কবিতার প্রারম্ভিক পঙ্ক্তির ‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’ কথাটা আমার কাছে দারুণ তাৎপর্যবহ ঠেকে।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.