জর্মন কবি-নাট্যকার গ্যেটে (জর্মন উচ্চারণ নিয়ে কের্দানি না করে বানানটা ‘গ্যেটে’-ই রাখলাম, চেনার সুবিধার কারনেই) যে দারুণ প্রতিভাবান, শক্তিশাল...

গ্যেটের ইউরোপকেন্দ্রিক মতাদর্শ || আজফার হোসেন

6:37 AM Editor 0 Comments

জর্মন কবি-নাট্যকার গ্যেটে (জর্মন উচ্চারণ নিয়ে কের্দানি না করে বানানটা ‘গ্যেটে’-ই রাখলাম, চেনার সুবিধার কারনেই) যে দারুণ প্রতিভাবান, শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী, তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই। তাঁর প্রধান কাজ _ফাউস্ট_ আমার সবসময়ই প্রিয়। কিন্তু এই মহান কবি-নাট্যকারও শেষ পর্যন্ত ইউরোপকেন্দ্রিক মতাদর্শকে বিভিন্নভাবে জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। বিষয়টা নিয়ে আমি এর আগে আমার একটা পোস্টে এবং বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ “বিশ্বসাহিত্যের রাজনীতি”-তে খানিকটা আলোচনা করেছিলাম। এবারে তাঁর কাজের আরেকটি দিক নিয়ে কয়েকটা কথা না বলে পারছিনা।

প্রথমেই বলা দরকার, গ্যেটের গীতিকবিতার একটি বিশেষ সংগ্রহ নিয়ে তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা তেমন কোনো আলোচনা করেন নাই। গ্যেটের এই বিশেষ সংগ্রহের নাম _ওয়েস্ট-ওস্টিলিকের দিওয়ান_ (ইংরেজিতে ‘ওয়েস্ট-ইস্টার্ন দিওয়ান’)। পারস্য সুফী কবি হাফিজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গ্যেটে ১৮১৪ থেকে ১৮১৮ সালের মধ্যে লিখে ফেলেন ১২ সর্গে ভাগ-করা আস্ত দিওয়ান। সন্দেহ নাই যে, ফার্সি কবিতা নিয়ে গ্যেটের আগ্রহ ছিলো গভীর। এও বলা যাবে যে, হাফিজকে নিয়ে গ্যেটের একধরণের ঘোর ও অভিভবও কাজ করেছে, যেমন সেটি আরেক প্রসঙ্গে ও পরিসরে কালিদাসকে নিয়েও কাজ করেছে বটে।

যাই হোক, গ্যেটে তাঁর হাফিজ-প্রভাবিত দিওয়ানে তাঁর মতো করেই কিন্তু আজকের লিবারেলদের গদগদ কায়দায় পূর্ব ও পশ্চিমের মিলন কামনা করেছেন। তবে ওই দিওয়ানে গ্যেটে বিভিন্ন ধরনের কবিতাভঙ্গি ও কবিতা হাজির করেছেন বটেঃ সেখানে আছে প্রতীকি কবিতা, ইঙ্গিতময় গল্প-ভরা আখ্যান, ইতিহাসের আঁকিবুকিতে ভরা গীতিকবিতা, হাফিজকে নিয়ে পুরা আখ্যান, তৈমুরকে নিয়ে আরেকটি আখ্যান, এমনকি জোলেখা-ইউসুফকে নিয়ে কবিতা ইত্যাদি।

কিন্তু হায়, এই মহান কবি গ্যেটের দিওয়ানেও পূর্বকে দেখা হয়েছে এক দারুণ দুর্বোধ্য, রহস্যময় কিন্তু রোমাঞ্চ-জাগানিয়া জগৎ হিসাবে, যে জগৎ শেষ পর্যন্ত গ্যেটের দৃষ্টিতে স্থবির, বৈচিত্র্যহী্ন‌ এবং এমনকি ইতিহাসবিহীনই হয়ে থাকে বটে। আরও বলা দরকার যে, পূর্বকে প্রশংসা করতে গিয়েও অনেক পশ্চিমা লেখক পূর্বকে স্থির স্পেস হিসাবে দেখেছেন বা বিবেচনা করেছেন। প্রায়ই একই ধরণের পূর্বকে হাজির দেখি ফরাসি রাজনৈতিক-দার্শনিক মতেস্কুর বিখ্যাত _পার্সিয়ান লেটারস_ (পারস্যের চিঠি)-এ। এই কাজটি ১৭২১ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো।

আরেকটি কাজের কথা এখানে না বললেই নয়; সেটি হচ্ছে মার্কিন কবি এডগার অ্যালেন পো’র একটা নাতিদীর্ঘ কবিতা, যার নাম ‘আল আরাফ’। ১৮২৯ সালে কবিতাটা প্রথম ছাপা হয়। কবিতায় পো কোরআন শরীফের ৭নং সূরাকে খানিকটা ব্যবহার করেছেন। ওই সূরার খানিকটা মধ্যস্ততায় এবং পো’র ভাষ্য মোতাবেক ‘আল আরাফ’ একটি বিশেষ স্থানকে নির্দেশ করে, যে স্থান ঝুলে থাকে বেহেশত ও দোজখের মাঝামাঝি, যেখানে বসবাস করে অর্ধেক পাপী অর্ধেক পুণ্যবানেরা, যারা বেহেশতে ও দোজখে—উভয় জায়গাতেই—যাওয়ার সম্ভাবনা ধারণ করে। কবিতাটা আসলেই বেশ জমে ওঠে পো’র দুর্দান্ত কাব্যকৌশলের কারণেই। কিন্তু গোল বাধে তখনই যখন পো ওই কবিতার কিছু কিছু জায়গায় আরব জগৎ নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। আর কথা বলেন এমনভাবে যে, মনে হয় ওই জগতে রয়েছে কেবল রহস্য আর রোমাঞ্চ, তার বেশি কিছু নয়।

আর আরব জগত নিয়ে পো’র ইঙ্গিতময় কাব্যিক বয়ান নিমেষেই মনে করিয়ে দেয় ইংরেজ আলোকচিত্রী ফ্রান্সেস ফ্রিথ (১৮২২-১৮৯৮)-এর মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ফটোগ্রাফির কথা; এমনকি আরও মনে করিয়ে দেয় সেই ১৯২১ সালে তৈরি-করা এবং জর্জ মেলফোর্ড পরিচালিত বিখ্যাত ‘সাইলেন্ট মুভি’র কথা, যার শিরোনাম _দ্য শেইখ_। এ প্রসঙ্গে হিটলারের একটা প্রিয় সিনেমার নামও উল্লেখ করা যায়। এই সিনেমাটার শিরোনামেই আমাদের অঞ্চলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শিরোনামটা হচ্ছে _দ্য লাইভস অফ এ বেঙ্গল ল্যান্সার_ । ১৯৩৫ সালে ছবিটা তৈরি করা হয়। আর ১৯৩০ সালে ফ্রান্সিস ইয়েটস-ব্রাউন (১৮৬৬-১৯৪৪) ওই একই শিরোনামে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস রচনা করেছিলেন।

দরকার, এই ইয়েটস-ব্রাউন একসময় মেজর হিসাবে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং ভারতের মাটিতেই তিনি ভারতকে দেখার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তার আগ্রহের দুটো এলাকাকে অনায়াসেই চেনা যায়। একটি হচ্ছে মুসলমান এবং অপরটি যোগ ব্যায়াম। উপন্যাসটিতে ইয়েটস-ব্রাউনের সাক্ষাৎ সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতায় ভারতের চিত্রায়ন প্রাচ্যবাদী অভিক্ষেপকে মোটেই এড়াতে পারেনি। সেখানে ভারত হয়ে উঠেছে একপেশে আধ্যাত্মিকতার আবাসভূমি, তার বেশ কিছু নয়। কিন্তু এই উপন্যাসের চেয়েও আরও বেশি প্রাচ্যবাদী হয়ে থাকে ওই সিনেমাটি। অবশ্য সিনেমাটা অনেকাংশেই মূল উপন্যাসের প্লট থেকে সরে এসেছে; ওখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে ভারতের দানা-বেঁধে-ওঠা স্বদেশীদের বিদ্রোহ দমনের বিষয়টা আর ওই বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর বীরত্বের কথা। অবশ্যই বলা যাবে যে, এই ছবিটির প্রতিটি মুহূর্তেই পুরুষতন্ত্র তার পেশি ফোলাতে থাকে। মোহাম্মাদ খান নামের একটা চরিত্রে পাওয়া যাবে এই ছবিতে। কিন্তু ছবিটাতে সে যতোটা না বিদ্রোহী, তার চেয়ে বেশি বর্বর।

হ্যাঁ, এভাবে সাদা চামড়ার মানুষেরা অনায়াসেই ভারতীয় মুসলমানদের এবং অন্যান্য অ-সাদাদেরও ‘বর্বরতা’র ছবি এঁকে ফেলে। আর হ্যাঁ, এভাবেই বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, প্রাচ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ হাত ধরাধরি করে চলে ইতিহাসে। চলে এখনও। বলাই বাহুল্য, এদের বিরুদ্ধে কোনো যুৎসই লড়াই একপেশে এবং এককাকালীন হতে পারে না মোটেই। অর্থাৎ নিপীড়নের বিভিন্ন ও বড় এলাকাগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই বিরাজমান সম্পর্কগুলো 'শর্ট সার্কিট' করে কেবল "মাইক্রো-পলিটিক্স" দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। এ বিষয়ে পরে আরও কথা হবে।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.