স ম্প্রতি পশ্চিমা মুলুকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমালোচনায় সম্পর্ক স্থাপনের বিচিত্র উৎসব লক্ষ্য করা যায়। ‘সম্পর্কই সত্য’­­─এমন এক মতাদর্শের বিস্ত...

বিশ্বসাহিত্যের রাজনীতি : গ্যেটে ও একটি চিঠির পঠন - আজফার হোসেন

2:05 PM Editor 0 Comments

ম্প্রতি পশ্চিমা মুলুকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমালোচনায় সম্পর্ক স্থাপনের বিচিত্র উৎসব লক্ষ্য করা যায়। ‘সম্পর্কই সত্য’­­─এমন এক মতাদর্শের বিস্তার ও বৈভব ওইসব সমালোচনায় চট করেই চোখে পড়ে। বছর তিনেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সাহিত্য সম্মেলনে জর্মন চিন্তক আর্নস্ট ব্লখ এবং স্লোভানিয়ার সংস্কৃতি তাত্ত্বিক স্লাভো জিজেকের দোহাই পেড়ে এক তরুণ সমালোচক আমাদের জানিয়েছিলেন যে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পঠনের কাজ হচ্ছে নতুন নতুন সম্পর্ক স্থাপন করা। ওই সমালোচক অবশ্য নিজের মতো করেই সেই কাজটি করেছিলেন; বেশ উৎসাহ নিয়েই তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন কি করে একজন আর্নস্ট ব্লখ তার কাজে বলশেভিক রাজনীতির সঙ্গে ইহুদি অধ্যাত্মবাদ আর ক্যাবালিস্ট পঠনতত্ত্বের দারুণ সংমিশেল ঘটান কিংবা কি করে একজন স্লাভোজ জিজেক হেঁচকা টানে হেগেল ও হিচকককে বা প্লেটো ও পতঞ্জলিকে একই সমতলে নিয়ে আসেন। একটি জাপানি হাইকু, একটি চৈনিক আইডিয়োগ্রাম, একটি মার্কিন ইমোজিস্ট কবিতা ও একটি ফার্সি রুবাই কীভাবে পঠনের ভেতর দিয়েই তাদের নান্দনিক সম্পর্কগুলো স্থাপন করে তা নিয়ে খানিকটা আলোচনাও করেছিলেন ওই তরুণ সমালোচক। আর তার আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘বিশ্বসাহিত্য ও সম্পর্কের কার্নিভাল।’

কিন্তু সম্পর্ক স্থাপনের কাজটি মোটেই নিরীহ নয়, কেননা সম্পর্ক স্থাপনে যে মধ্যস্থতার প্রয়োজন পড়ে তা বিভিন্নভাবেই পরিপ্রেক্ষিতনির্ভর মতাদর্শিক অভিক্ষেপকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্দেশ করে বটে। অর্থাৎ যে প্রশ্নগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো হচ্ছে─ কার সঙ্গে কার সম্পর্ক? কিসের সম্পর্ক, কী ধরণের সম্পর্ক? আর সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা করছে কে বা কারা অথবা কোন বিষয়? সময় ও পরিসর, ঐতিহাসিকতা ও ভৌগোলিকতাও সম্পর্ক স্থাপনে বা সম্পর্কের ধরন নির্ণয়ে কাজ করে থাকে। অঙ্কশাস্ত্র এবং দর্শন নিয়ে একটা ঠাট্টা প্রচলিত আছে। সেটা হলো─ অঙ্কশাস্ত্র হচ্ছে সেই খেলা যার নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন আছে কিন্তু উদ্দেশ্য নেই। অন্যদিকে দর্শন হচ্ছে সেই খেলা যার উদ্দেশ্য আছে কিন্তু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন নেই। অবশ্যই এ ক্ষুদে ঠাট্টা দিয়ে অঙ্কশাস্ত্র ও দর্শনের তাবৎ স্বরূপকে বোঝানো হচ্ছে না মোটেই। তবে ঠাট্টায় ব্যবহৃত রূপকটা খেয়াল করার মতো, সে রূপকটা হচ্ছে খেলা। এবং খেলা বা লীলা আবার সম্পর্ক স্থাপনকেই নির্দেশ করে এমনিভাবে যে, সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে নিরীহ ঠেকে না। অঙ্কশাস্ত্র প্রসঙ্গে ইউরোপীয় আলোকায়ন প্রকল্প বরাবরই প্রচার করেছে যে, সংখ্যার সঙ্গে সংখ্যার যৌক্তিক সম্পর্ক নির্মাণ করে অঙ্কশাস্ত্র, তা নৈর্ব্যক্তিক, মতাদর্শনিরপেক্ষ। হাল আমলে এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে─ একবার নয়, একাধিকবারই। এ প্রসঙ্গে আমার বিশেষ করে মনে পড়ছে একটি সাম্প্রতিক গ্রন্থের কথা, যার শিরোনাম এথনোম্যাথেমেটিকস্‌। বইটি বেশ কয়েকটি অঙ্কবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন। আর সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন আর্থার পাউয়েল ও ম্যারিলিন ফ্যাংকেনস্টাইন। বইটির একাধিক প্রবন্ধে একাধিক বিষয়ের মধ্যে যে দুটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো─ এক. অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে যা তা হচ্ছে সম্পর্ক এবং তার বিন্যাস ও বিস্তার। দুই. এ সম্পর্ক মোটেই মতাদর্শনিরপেক্ষ নয়, কেননা বিশেষ বিশেষ গাণিতিক যুক্তিকে বিশেষ বিশেষ দিকে চালনা করার ক্ষেত্রে আঙ্কিক স্বতঃসিদ্ধগুলো ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত মতাদর্শিক ঝোঁককে প্রকাশ করে থাকে। বইটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে, অঙ্কশাস্ত্র নিজেই কয়েক শ’ বছর ইউরোপকেন্দ্রিক মতাদর্শিক আধিপত্যকে লালন করেছে।

তাহলে এমনসংখ্যাও কি নিরীহ নয়, সংখ্যার সম্পর্কও নিরীহ নয়, ‘বিশ্ব সাহিত্য তো নয়-ই। কিন্তু কি এই ‘বিশ্বসাহিত্য?’ কোন বিশ্ব? কার বিশ্ব? কোন সাহিত্য ? কার সাহিত্য? এ প্রশ্নগুলোর ইতিহাস আছে, যে ইতিহাসে ইউরোপীয় ধ্যানধারণার ভূমিকা আছে, আছে তাদের মতাদর্শিক আধিপত্যের বিষয়টি, যা বোঝার জন্য আমরা ইউরোপীয় সাহিত্যের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রশংসিত ব্যক্তিত্বের কাছে যেতে পারি। তিনি হলেন অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর জর্মন কবি-নাট্যকার-ঔপন্যাসিক-চিত্রকর-তাত্ত্বিক-বিজ্ঞানী যোহান উলফগ্যাংগ ফন গ্যয়েতে (বা ‘গ্যেটে’; আমি ‘গ্যেটে’ বানানটাই ব্যবহার করব)।

না, গ্যেটের সবচেয়ে পরিচিত কাজ ফাউস্ট নিয়ে এখানে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয় অথবা গ্যেটের অন্যান্য কবিতার মূল্যায়নও আমার লক্ষ্য নয়। তবে যে কথাটা এখানে চট করে বলে নিতে চাই তা হলো, ‘বিশ্বসাহিত্য’ বর্গটি (জর্মন Weltliteratur) প্রথম যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তিনিই হলেন গ্যেটে। আর যার সুবাদে ওই বর্গটি প্রকাশিত হয়েছিল তিনি হলেন গ্যেটের তরুণ শিষ্য যোহান পিটার একেরমান। বলা দরকার, বিভিন্ন সময়ে গুরুর সঙ্গ শিষ্যের সাহিত্য নিয়ে লিখে আলোচনা হতো। এসব আলোচনার চমৎকার বিবরণ আমরা একেরমানের কাছ থেকেই পেয়েছি। একেরমানের বিবরণ মোতাবেক তাদের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল জার্মানির বাইরের সাহিত্য। গ্যেটে যে বইগুলো ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয় ও লাতিন ভাষায় পড়তেন, সেগুলো তার তরুণ শিষ্যকেও পড়ার জন্য বারবারই উপদেশ দিতেন এবং অনুবাদেও সাহিত্য পড়ার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল গ্যেটের। শুধু জর্মন সাহিত্য পাঠে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা মোটেই যথেষ্ট নয়, জাতীয় সীমান্তের বাইরেও যেতে হবে─ এ বোধটা তার শিষ্যের মধ্যে জাগানোর ক্ষেত্রে বেশ সচেষ্ট ছিলেন গ্যেটে। অবশ্যই বলা যাবে যে, শেক্সপিয়ার নিয়ে গ্যেটের অভিভব ছিল; তিনি একেরমানকে বলতেন শেক্সপিয়ারের ‘অনন্ত বৈভব ও ঐশ্বর্য’─ এর কথা। তিনি বলতেন ফরাসি নাটকের নৈপুণ্যের কথা। ইতালীয় সাহিত্যের পাঠ তাকে আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত করেছে বারবারই। এভাবে গ্যেটে দেশের বাইরে বেরিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু গোল বাধে তখনই যখন তিনি মহাদেশের অর্থাৎ ইউরোপের বাইরে বেরিয়ে পড়েন। বিষয়টি খানিকটা তলিয়ে দেখা যাক।

১৮২৭ সালের ২৯ জানুয়ারি একেরমানের সঙ্গে গ্যেটের কথপোকথনে যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছিলো সেগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন ছিল সমকালীন ফরাসি কবিতা এবং হোরেসের লাতিন কবিতা, অন্যদিকে তেমনি ছিল হাফিজের ফার্সি কবিতা। ফরাসি থেকে ফার্সিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্যেটের প্রাচ্য নিয়ে আগ্রহ ও ক্ষেত্রবিশেষে অভিভবের লক্ষণ শনাক্ত করেছেন একেরমান নিজেই। কিন্তু ওই বিশেষ কথোপকথনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল তা ছিল একটি ভাষান্তরিত কবিতা─ জর্মন ভাষায় একটি সার্বীয় কবিতা, যার প্রশংসায় গদগদ ছিলেন গ্যেটে।

কিন্তু ইউরোপ থেকে বেরিয়ে পড়ার বোধ কবি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটল তখনই যখন গ্যেটে প্রায় উন্মাদের মতো চীনা সাহিত্য পড়া শুরু করলেন। এ যেন এক মহাদেশ আবিষ্কারের আনন্দ! বিশেষ করে একটি চৈনিক উপন্যাস তার মনোযোগকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। কিন্তু ওই আনন্দ ও মনোযোগেরও সীমানা-ঠিকানা নির্ধারিত হয় গ্যেটের জর্মন জাতীয়তাবাদী চশমার চোখে। গ্যেটের প্রতিক্রিয়া এমন; চীনা সাহিত্য উৎকৃষ্ট ‘আমাদের’ সাহিত্যের মতোই; চীনারা তো ‘আমাদের’ (জর্মনদের) মতোই চিন্তা করে, অনুভব করে। এভাবেই চীনাদের সঙ্গে জর্মনদের সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হন গ্যেটে। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য এই যে, গ্যেটে নিজেই নিজের কাজ হারমান অ্যান্ড ডরোথিয়া ও রিচার্ডসনের ইংরেজি উপন্যাসের সঙ্গে ওই চীনা উপন্যাসের তুলনা করেন এবং এ আবিষ্কারের আনন্দে বগল বাজাতে থাকেন। বলা দরকার, বিশ্বসাহিত্যের আরেক নাম যে ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ সেই ইঙ্গিতটাও খানিকটা পাই গ্যেটের কাছ থেকেই এবং রবি ঠাকুরের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বিশ্বসাহিত্য’─এ গ্যেটে এই ধারণার খানিকটা আবেগস্পন্দিত মহড়া আমরা লক্ষ্য করি বটে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

চীনা উপন্যাস নিয়ে আগ্রহ, আনন্দ ও ক্ষেত্রবিশেষে অভিভবের পরিপ্রেক্ষিতেই এবং ‘তুমি ভালো কেননা তুমি আমার মতোই’ এই বোধ বা মূল্যায়নে আন্দোলিত হয়েই গ্যেটে ওই ১৮২৭ সালে ‘বিশ্বসাহিত্য’ বর্গটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। একেরমানকে লেখা এক চিঠিতে গ্যেটে বলেন এভাবে; ‘জাতীয় সাহিত্য এখন একটি অর্থহীন বর্গ। বিশ্বসাহিত্যের যুগ আসন্ন এবং এর আগমনকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সবাইকেই সচেষ্ট হতে হবে।’

অবশ্যই বলতে হবে, জর্মন সাহিত্য নিয়ে গ্যেটে যে সব সময় তৃপ্ত ছিলেন তা নয়। এও বলা দরকার যে, আন্তর্জাতিকতাবোধের ওপর গ্যেটে জোর দিয়েছেন বরাবরই। সাহিত্য উৎপাদনের স্বার্থেই সাহিত্যের পঠনের দিগন্তকে সম্প্রসারিত করার তাগিদ গ্যেটের কাছে থেকেই পাই। তবে গ্যেটে যেখানে থামেন, সেখানে অগ্রসর হন মার্কস ও এঙ্গেলস্‌। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে তারা কেবল বিশ্বসাহিত্যের আগমনের কথাই বলেন না। আরো বলেন, পুঁজির জাতীয় সীমান্তবিরোধী বা বিধ্বংসী লজিক ওই বিশ্বসাহিত্যকে বা বুর্জোয়া বিশ্বসাহিত্যকে অনিবার্য করে তুলেছে। অন্য কথায়, পুঁজির রাজনৈতিক অর্থনীতির বিচার ছাড়া বিশ্বসাহিত্যের স্বরূপ বা রূপ বোঝা সম্ভব নয়। পুঁজি যেমন নিজের সঙ্গে শ্রমকে, স্থানের সঙ্গে স্থানকে সম্পর্কিত করে, ঠিক তেমনি সাহিত্যের সঙ্গে সাহিত্যকেও সম্পর্কিত করার ভেতর দিয়ে পুঁজি বিশ্বসাহিত্যকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। পুঁজি শ্রম শোষণ করে যেমনি, তেমনি সাহিত্যও সাহিত্যকে শোষণ করতে পারে। সব ক্ষেত্রেই আমরা কেবল সম্পর্কের বিস্তারই লক্ষ্য করি না, আমরা আরো দেখি অসম উৎপাদন-সম্পর্কেরও অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন। এসব বিষয় বেরিয়ে আসি কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর পুনর্পঠনের ভেতর দিয়ে।

কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতি গ্যেটের অভিনিবেশের এলাকা ছিল না, থাকার তেমন কারণও নেই, যদিও বিভিন্ন এলাকায় গ্যেটের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি এবং অবাধ পরিব্রাজনার কথা আমরা জানি। যে সময় গ্যেটে লিখছিলেন, সে সময় আধুনিক পুঁজিবাদ বেশ বিকশিত এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ পুঁজিবাদেরই বিস্তারী ও ভূমি দখলকারী লজিক হিসেবে কাজ করে চলেছে, যদিও উপনিবেশবাদকে কেবল পুঁজিবাদের ‘টেরিটোরিয়াল লজিক’ হিসেবে বিবেচনা করলে বহু ধরনের তাত্ত্বিক ঝুঁকি থেকে যায়। সেই আরেক প্রসঙ্গ তবে ইউরোপীয় ইতিহাসের এ মুহূর্তে বুর্জোয়া নন্দনতাত্ত্বিক প্রকল্পও বেশি বিকশিত হয়েছে, যার সঙ্গে রয়েছে ইউরোপের পুরো আলোকায়ন প্রকল্পেরই বিভিন্ন লেনদেন। ইতিহাসের এই বহুল-ভারাক্রান্ত মুহূর্তেই গ্যেটে লিখেছিলেন ওই চিঠিটা, যা থেকে একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি এর মধ্যেই পেশ করেছি। এবার ফেরা যাক চিঠির বাকি অংশে। দেখা যাক গ্যেটের আন্তর্জাতিকবোধের মতাদর্শিক লব্ধিগুলো কীভাবে কাজ করে।

একেরমানকে লেখা ওই চিঠিতে গ্যেটে আরো বলেন, ‘যদিও এভাবে আমরা যা কিছু ভিনদেশী তাকে মূল্য দেব, কোনো বিশেষ বিষয়ের প্রতি অন্ধ হয়ে তাকে মডেল হিসেবে ভুল করা ঠিক হবে না। এই মূল্যটা আমরা চীনাদের বা সার্বীয়দের বা ক্যালডেরনকে দেব না। কিন্তু আমরা যদি একটি প্রতিমান (বা মডেল) চাই, প্রাচীন গ্রিকদের কাছেই আমাদের সব সময় ফিরে যেতে হবে, যাদের কাজ মানবজাতির চিরন্তন সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্ব করে। বাদ বাকি সব আমরা ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করব আর আত্মসাৎ করব যা কিছু উৎকৃষ্ট তাই, যতদূর পারা যায়।’

তাহলে উপরের উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে থাকে। প্রথমত. গ্যেটে পুনরাবৃত্ত ‘আমরা’ কেবলমাত্র শ্বাসাঘাতের বিষয় নয়, সেই ‘আমরা’ অন্যকেও নির্দেশ করে; সম্পর্কিত হয় সেই ‘আমরা’ আবার ‘বাদ বাকি সব’─ এর সঙ্গে। এ সম্পর্ক স্পষ্টতই সমতার সম্পর্ক নয়, তবে ক্ষতমার সম্পর্ক তো বটেই। দ্বিতীয়ত. এই সম্পর্কে গ্যেটের চীনপ্রেমের দৌড় চীন পর্যন্ত নয় মোটেই। তৃতীয়ত. ওই সম্পর্কে শীর্ষস্থানে প্রশ্নাতীতভাবে অধিষ্ঠিত থাকে গ্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এখানে কেন্দ্র-প্রান্তের অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের তুলনাটা চলে আসে; ‘আমরা’ থাকি কেন্দ্রে, ‘বাদ বাকি সব’ থাকে প্রান্তে; গ্রিক সাহিত্য থাকে কেন্দ্রে, অন্য সাহিত্য প্রান্তে। এভাবে ‘নিজ/অন্য’ বা ‘আমরা/তারা’ সম্পর্কগুলো এখানে এক ধরনের প্রতার্কিক বৈধতা অর্জন করে বটে। এখানে বলে নেওয়া দরকার যে, এই ‘আমরা/তারা’ সম্পর্ক একটি তৈরি করা সম্পর্ক, ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত সম্পর্ক, যা একই সঙ্গে জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্ক। এই সম্পর্কে গ্রিস ও এমনকি মিসরও অনিবার্যভাবেই পাশ্চাত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

এভাবে পাশ্চাত্যের ডিসকোর্সে─ বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ডিসকোর্সে─ আমরা গ্রিক সভ্যতাকে পশ্চিমা বা ইউরোপীয় সভ্যতার অংশ হয়ে উঠতে দেখি, যদিও এক সময় মিসর ও গ্রিসকে পুবের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। এখানে কৃষ্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক মোফেলকে অসান্তে ও জ্যামাইকান দার্শনিক চার্লস মিলসের কথা উল্লেখ করতে হয়। তাদের মতে, সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার মতোই মিসর ও গ্রিসকে ছিনিয়ে নিয়েছে পশ্চিম; উপনিবেশবাদী আধিপত্যের স্বার্থেই এবং তথাকথিক ‘অসভ্য’ মানুষকে শাসন ও দমন করার লক্ষ্যেই নতুন মানচিত্র, নতুন বিভাজন, নতুন ডিসকোর্স জন্মলাভ করেছে ওই ইউরোপেই। জোর দিয়েই বলা দরকার যে, এগুলো ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী প্রকল্পের প্রতার্কিক অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এসব অনুশীলন যে হেজিমনি তৈরি করেছিল ইউরোপীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে, সেই হেজিমনির বলয় বা দিগন্তের অভ্যন্তরেই অবস্থান করে গ্যেটের ওই চিঠিটা। লক্ষ্যে করুন গ্যেটে কীভাবে ওই চিঠিতে ‘আত্মসাৎ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কে কাকে আত্মসাৎ করবে? গ্যেটে পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছেন যে, তাদের নিজস্ব শ্রেয়সের ধারণা অনুযায়ী তারা অন্যদের যা কিছু ভালো তাই আত্মসাৎ করেতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।

ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্য এখানে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া দরকার। প্রথমত. এখানে আমি গ্যেটের মাত্র একটি চিঠির এক ধরনের সিমপটোম্যাটিক পঠন অগ্রসর করার চেষ্টা করছি। প্রশ্ন জাগতে পারে, মাত্র একটি ছোট চিঠির পঠনের ভেতর দিয়ে কি গ্যেটের মতাদর্শিক অভিমুখ ও অভিক্ষেপের সমগ্রকে ধরা সম্ভব? মোটেই নয়। কিন্তু এও জোর দিয়ে বলা দরকার যে, গ্যেটের ওই চিঠিটা ছোট হলেও অতো ছোট নয় এই অর্থে যে চিঠিটা একদিকে যেমনি প্রাশ্চাত্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ওই চিঠির তর্জনি নির্দেশকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পরিসরে শিরোধার্য করেছেন পাশ্চাত্যের একাধিক লেখক ও তাত্ত্বিক, বিশেষভাবে তারা যারা তুলনামূলক সাহিত্যের এলাকায় কাজ করে চলেছেন। সম্প্রতি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ডেভিড ড্যামরোশ একটি বই লিখেছেন, যার শিরোনাম হোয়াট ইড ওয়ার্ল্ড লিটারেচার ? লক্ষ্য করছি, ড্যামরোশ সাহেব গ্যেটের ওই চিঠির একটি পঠন দিয়ে তার বইটি শুরু করেছেন। তিনি গ্যেটের প্রশংসা করেছেন (গ্যেটের অন্যান্য কাজের প্রশংসা আমিও করি) এবং ক্ষেত্রবিশেষে ড্যামরোশ সাহেব গ্যেটের সমস্যাও চিহ্নিত করেছেন। সেটি হলো গ্যেটের নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক এলিটিজম। কিন্তু শুধুই এলিটিজম? গ্যেটের বক্তব্যের সঙ্গে বিশেষ করে ওই চিঠির বক্তব্যের সঙ্গে ইউরোপীয় প্রতার্কিক অনুশীলনের যে হেজিমনি তৈরী হয়েছিল ঊনিশ শতকে, তা ওই ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী এবং এমনকি প্রাচ্যবাদী ও বর্ণবাদী প্রকল্পের স্বার্থেই, সেই হেজিমনির সম্পর্ক নিয়ে একেবারেই চুপ থেকেছেন ড্যামরোশ সাহেব। এসব কারণেই আমার মনে হয়েছে যে, গ্যেটের ওই মহাপ্রভাবশালী চিঠিটা আবারো পড়া দরকার এবং ধরা দরকার। এখানে এও বলে রাখা প্রয়োজন যে, রবি ঠাকুরের ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে আমরা গ্যেটের আধিপত্যবাদী সম্পর্কতত্ত্বের একটা মহড়া লক্ষ্য করি, যদিও রবীন্দ্রনাথ ওই প্রবন্ধে গ্যেটের নাম সরাসরি উল্লখ করেননি।

দ্বিতীয়ত. আমি একেরমানকে লেখা গ্যেটের চিঠিটাকে একটা ছুতো হিসেবে ব্যবহার করেছি কয়েকটি প্রশ্ন তোলার তাগিদেই। অর্থাৎ আমরা যাদেরকে ক্লাসিক লেখক হিসেবে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বা যেসব লেখক মহৎ বা সর্বজনীন হিসেবে আমাদের মগজের ভেতর ‘স্থায়ী’ আসন গেড়েছে, তারা আসলেই কতটা মহৎ বা সর্বজনীন? তাদের মতাদর্শিক জায়গাটা বৃহত্তর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিগন্তের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত? আর যে সম্পর্ক বা যোগাযোগ তৈরি করার ওপর গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ─ অবশ্য দুটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক পরিসরে-জোর দিয়েছেন, সেই সম্পর্ক বা যোগাযোগ কী ধরনের? একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী একজন শ্রমিককে বুকে জড়িয়ে ধরলেই কি সেখানে সম্পর্ক স্থাপিত হয়? আমি মনে করি বিউপনিবেশীকরণের স্বার্থেই বা যে কোন সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের স্বার্থেই ওপরের প্রশ্নগুলো তোলা যায়।

সবশেষে এই বলতে চাই যে, আমি মোটেই ‘ক্ল্যাসিকস’ পড়ার বিরুদ্ধে নই কিংবা আমি গ্যেটের মতো একজন প্রভাবশালী সাহিত্যিকের সমৃদ্ধ রচনাগুলোকে মোটেই অবহেলা করার পক্ষে নই। তবে দেখা দরকার আমরা সেগুলোকে কীভাবে পড়ছি এবং কেন পড়ছি। মোহ আর অভিভব মুক্তিকামী সমালোচনার সাক্ষাৎ শত্রু, যেমন তার আরেক শত্রু না বুঝে বা না শুনে তাৎক্ষণিক বর্জন।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.