হিস্পানি কবি বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে (Vicente Aleixandre) বাংলাদেশে ততটা পরিচিত নন, যতটা পরিচিত আরেক হিস্পানি কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, যদি...

বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের দশটি কবিতা - আজফার হোসেন

8:59 AM Editor 0 Comments

হিস্পানি কবি বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে (Vicente Aleixandre) বাংলাদেশে ততটা পরিচিত নন, যতটা পরিচিত আরেক হিস্পানি কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, যদিও আলেকজান্দ্রে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে। এমনকি পশ্চিমা মুলুকেও অন্যান্য হিস্পানি ও লাতিন আমেরিকার কবির তুলনায় আলেকজান্দ্রে তেমন পরিচিত নন, যদিও বিশ শতকের একজন প্রধান ও শক্তিশালী কবি হিসাবে আলেকজান্দ্রেকে বিশেষভাবে তারিফ করেছেন লোরকা নিজেই। শুধু লোরকাই নন, আলেকজান্দ্রেকে বিভিন্নভাবেই শ্রদ্ধা ও অভিবাদন জানিয়েছেন হিস্পানি ভাষার আরও কবি–পাবলো নেরুদা, রাফায়েল আলবের্তি, হেরার্দো দিয়েগো, মিগেল এর্নান্দেসসহ অনেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে ফরাসি দার্শনিক অ্যালান বাদিউর ‘ইনএসথেটিকস্’ (inaesthetics)-এর ধারণার সুবাদে ফরাসি কবি স্তেফান মালার্মের কবিতার পাশাপাশি বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের কবিতাকে নতুন করে পড়া শুরু করেছেন একদল পশ্চিমা তরুণ দার্শনিক। কিন্তু কী এই ‘ইনএসথেটিকস্’? বাদিউর নিজস্ব ভাষ্য এভাবে পেশ করা যায় : যাকে ‘ইনএসথেটিকস্’ বলা হচ্ছে তা আসলে শিল্পের সঙ্গে দর্শনের একটা বিশেষ সম্পর্ককে নির্দেশ করে এটাই বুঝিয়ে যে, শিল্প নিজেই সত্য উৎপাদন করে, আর সে কারণেই শিল্পকে দর্শনের নিছক ‘অবজেক্ট’ হিসেবে বিবেচনা করায় শিল্পের ঘোরতর আপত্তি থাকে। এও বলা দরকার, ‘ইনএসথেটিকস্’-এর এই ধারণাটা সনাতন বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের তথাকথিত বিশুদ্ধতাবাদের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে যায়। আর ওইসব তরুণ দার্শনিক বাদিউর এই ধারণাকে ব্যবহার করেই মালার্মের আর আলেকজান্দ্রের কবিতা পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তবে না বলে পারছি না যে, আমার নিজের আগ্রহের বয়স তাঁদের আগ্রহের এই সাম্প্রতিকতাকে ছাড়িয়ে যায়। কেননা বাংলাদেশে সেই আশির দশকের মাঝামাঝি আমি বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের একটা প্রেমের কবিতা প্রথম অনুবাদ করি। বাংলায় কবিতাটির নাম দিয়েছিলাম ‘প্রেম এবং তারপর’।

১৮৯৮ সালে ২৬ এপ্রিল স্পেনের সেভিলে (স্প্যানিশ-এ ‘সেবিয়া’) জন্মেছিলেন বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে। ঠিক একই বছর, কিন্তু মাস দুয়েক পরে, লোরকাও স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন। আলেকজান্দ্রে মারা যান ১৯৮৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে সেভিলের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত ভূমধ্যসাগরের কিনারায় মালাগাতে, যদিও পরে তিনি মাদ্রিদের স্থায়ী বাসিন্দা হন। ওই মাদ্রিদেরই একটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন পড়েন এবং পরে বাণিজ্য আইনের শিক্ষকও হন। একই সঙ্গে তিনি এমনকি অর্থনীতির একটি রিভিউধর্মী জার্নাল সম্পাদনার কাজে সহযোগিতাও করেন। একসময় বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে রেলওয়ে কোম্পানিতে চাকরি নেন এবং তাঁর জীবনের প্রথম প্রকাশিত রচনাগুলো ছিল রেলগাড়ি নিয়েই, যে রেলগাড়ি অবশ্য রূপক ও চিত্রকল্প হয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর কবিতায় হাজির হয়েছে, যদিও তাঁর কবিতার ভাষাশিল্প আর বাণিজ্য আইনের ‘দুর্ভাষা’ একই সঙ্গে যায় না। তবে হয়তো এভাবে বলা যায় যে, তিনি তাঁর কবিতায় ঘটিয়েছিলেন এক নতুন চৈহ্নিক অর্থনীতির উদ্বোধন, যে অর্থনীতিতে শব্দ ও চিহ্নের উৎপাদন, বিনিময় এবং বণ্টন সনাতন বুর্জোয়া কার্য-কারণ সম্পর্ককে তছনছ করে দিয়ে কবিতার স্পেসে তৈরি করেছে নেতি, অস্তি ও গতির এক নতুন ভাষা।

বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের কবিতা লেখার ইতিহাসে ১৯১৭ সালের এক গ্রীষ্ম বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেই গ্রীষ্মে আলেকজান্দ্রেকে তাঁরই এক প্রিয় বন্ধু একটা বিশেষ উপহার দেন; সেটা ছিল হিস্পানি ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, নিকারাগুয়ার কবি এবং হিস্পানি আধুনিকতাবাদী কাব্যান্দোলনের পুরোধা রুবেন দারিওর কবিতার বই! দারিও দারুণভাবে নাড়া দেন বিসেন্তে আলেকজান্দ্রেকে, যেন তাঁর অন্তরাত্মায় ঘটে যায় ‘রুশ’ বিপ্লব! এরপর তিনি পাগলের মতোই দিনরাত পড়তে থাকেন আরও দুই জন হিস্পানি কবিকে–এঁদের একজন হলেন আন্তোনিও মাচাদো, অন্যজন হুয়ান রামোন হিমেনেথ, যিনি আবার আমাদের রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর দ্বারা বেশ প্রভাবিতও হয়েছিলেন, যেমন রবীন্দ্রনাথের দ্বারা একসময় খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন স্বয়ং পাবলো নেরুদাও। সেটি আরেক প্রসঙ্গ। তো, তাঁর পূর্বসূরিদের দ্বারা আন্দোলিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে এবং মুগ্ধতার আনন্দে এবার বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে নিজেই কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু গোপনে। এভাবে তাঁর কবিতা লেখা চলে কমপক্ষে আট বছর।

বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের প্রথম কবিতার বই বের হয় ১৯২৮ সালে। বইটার নাম Ambito। এরপর ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া-জাগানো কবিতার বই Pasión de la tierra (মাটির প্যাশন)। তাঁর জীবদ্দশায় বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের প্রায় ৩০টি কবিতার বই বেরিয়েছিল। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হোল La destrucción o el amor (ধ্বংস কিংবা প্রেম, ১৯৩৫); Sombra del paraíso (জান্নাতের ছায়া, ১৯৪৪); Historia del corazón (হৃদয়ের ইতিহাস, ১৯৫৪); En un vasto dominio (একটি বিশাল এলাকা, ১৯৬২); এবং Poesia surrealista (পরাবাস্তববাদী কবিতা, ১৯৭১)। এছাড়া স্পেনে আলেজান্দ্রো দুকে আমুস্কোর প্রশংসনীয় ও গতিশীল সম্পাদনায় ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের কবিতাসমগ্র আর ২০০২ সালে বেরোয় তাঁর গদ্যসমগ্র।

কবি হিসেবে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের সামগ্রিক মূল্যায়ন ও চরিত্রায়ন বর্তমান ভূমিকার অল্প পরিসরে একেবারেই অসম্ভব; আর সেটা আমার উদ্দেশ্যও নয়। তবে নিচের কবিতাগুলো– অনুবাদে হলেও কবির কিছু প্রিয় বিষয়, মোটিফ এবং এমনকি তাঁর শৈলীগত আচরণের কিছু দিককেও খানিকটা নির্দেশ করবে বলে আশা করি। তবে এখানে এও বলে নেওয়া দরকার যে, বিসেন্তে আলেকজান্দ্রেকে প্রায়ই ‘২৭-এর প্রজন্ম’-এর কবি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এই পরিচয় ঐতিহাসিকভাবে সত্য বটে। এই ‘২৭-এর প্রজন্ম’ ছিল স্পেনের সেই সময়ের একটি প্রচল এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধী শিল্পান্দোলনের নাম, যে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিসেন্তে আলেকজান্দ্রেসহ স্পেনের বেশ কিছু শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখক-শিল্পী। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন হর্হে গিয়েন, পেদ্রো সালিনাস, রাফায়েল আলবের্তি, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এবং মিগেল হার্নান্দেজ। এই ফর্দ মোটেই সম্পূর্ণ নয়। অন্যান্যের মধ্যে ওই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্রকার লুইস বুনুয়েল এবং চিত্রকর সালভাদোর ডালি। এঁদের কাজের বিপুল বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এঁদের মিল ছিল প্রথা এবং প্রচলকে–এবং বিরাজমান আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেও–বিভিন্নভাবে চ্যালেঞ্জ করে শিল্প নিয়ে তুমুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়, যেমন বিভিন্নভাবেই কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে নিজেই। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণেই তাঁকে কখনও বলা হয়েছে ফ্রয়েড-প্রভাবিত পরাবাস্তববাদী, কখনও অস্তিত্ববাদী, কখনও ভিশনারি, এমনকি নব্য-রোমান্টিকও। কিন্তু তারপরও আলেকজান্দ্রেকে নির্দিষ্ট এবং সীমিত ছাঁচে চরিত্রায়িত করার রেওয়াজ দাঁড়িয়ে গেছে এর মধ্যেই, যা আমরা লক্ষ করি আমাদের জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ উভয়কেই এখনও নির্জনতার ও বিষণ্ণতার এবং এমনকি অন্ধকারের কবি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু জীবনানন্দের মতোই বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে মোটেই নির্জনতায় আর অন্ধকারে আটকে থাকেন না, বরঞ্চ উভয়েই চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে মানুষের শক্তি, ঐশ্বর্য, সম্ভাবনা আর সংগ্রামকেই উদযাপন করেন। আলেকজান্দ্রে তাঁর যাত্রা ‘নেতি’ থেকে শুরু করলেও তিনি এগুতে থাকেন হেগেলীয় ‘নেতির নেতির’ দিকে, যা আসলে জীবনের ইতিবাচকতাকেই নির্দেশ করে। জীবনানন্দের মতোই যেন বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে সাতটি তারার তিমির দেখেন ঠিকই, কিন্তু এও বলে উঠেন (আমি এখানে জীবনানন্দের ভাষাই ব্যবহার করছি) : “আছে আছে আছে এই বোধির ভিতরে/ চলছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের হৃদয়।”

অথবা জীবনানন্দের এই কথাটাও অনায়াসেই হতে পারে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের উচ্চারণ : “আঘাত ছাড়া কোনো অগ্রসর সূর্যালোক নেই।”

আলেকজান্দ্রের প্রেমের কবিতা নিয়ে এখানে দু-একটা কথা বলে নেওয়া যাক। তাঁর লাইনে লাইনে বিষণ্ণতা এবং আনন্দ পরস্পর পরস্পরকে প্রায়শ জড়িয়ে ধরে তৈরি করে এক কাব্যিক ‘ডায়ালেকটিকস’। কিন্তু এও দেখা যায় যে, তিনি প্রেমকে হাজির করেন ইতিহাসের ভিতরেই, সেই ইতিহাসে যেখানে সময়ের বয়ে-যাওয়ার ভিতর দিয়েই সময়হীনতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে, যেন ঘটে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর উদ্ভাসন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার অনুবাদে আলেকজান্দ্রের নিচের একটি কবিতায় কবি নিজেই ইঙ্গিত দেন কী করে প্রেমের একটি বিকেল হয়ে উঠতে পারে অনন্তকাল। এও বলা দরকার, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বা নিউটনীয় সময়ের সঙ্গে মহাকালের দ্বন্দ্বকে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে বিভিন্নভাবেই তাঁর চিত্রকল্পের বিভিন্ন বিন্যাসে হাজির করেছেন, যেমন ইতিহাস নিজেই হাজির হয় কোনো বাগবিস্তারে নয়, এমনকি কোনো নির্দিষ্ট বয়ানেও নয়, বরঞ্চ সে হাজির হয় সরাসরি চিত্রকল্পেই, ঠিক যেমনটি বলেছিলেন বিশ শতকের অন্যতম সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ও সাহিত্যসমালোচক ওয়ালটার বেনজামিন, যিনি সনাতন রৈখিক পারম্পর্যে বিন্যস্ত বুর্জোয়া ঐতিহাসিক বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তাঁর চিত্রকল্পবাদী ইতিহাসতত্ত্ব দিয়ে। চিত্রকল্পের আপাতসীমিত স্পেসে ইতিহাসকে নিমিষেই ঝলকে তোলার আলেকজান্দ্রীয় প্রবণতা এই কবিকে আরও দুজন কবির কাছাকাছি নিয়ে আসে– এঁরা হলেন একদিকে আমাদের জীবনানন্দ এবং অন্যদিকে হিস্পানি ভাষার আরেক কবি, বলিভিয়ার অন্যতম প্রধান কবি, হাইমে সায়েনজ। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করতে আগ্রহী, তারা নিঃসন্দেহে এই তিনজন কবিকে নিয়ে তুমুল তুলনামূলক আলোচনার পথ সহজেই খুঁজে পাবেন বলে মনে হয়।

এবারে আসি বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের শৈলী প্রসঙ্গে। এখানে আমি আবারও পরিসরের কারণেই তাঁর শৈলীগত এবং ভাষিক আচরণের মাত্র দুয়েকটি দিক স্পর্শ করতে পারব, তার বেশি কিছু নয়। বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে তাঁর কবিতায় উপমা-রূপক এবং চিত্রকল্পের ‘ডায়ালেকটিকস্’ নির্মাণ করেছেন নিরন্তর। অর্থাৎ তাঁর কবিতায় একদিকে থাকে যেমন রূপক ও চিত্রকল্পের সংঘর্ষ, অন্যদিকে তেমনি থাকে তাদের ঘূর্ণি; থাকে তাদের সাবলীল কিন্তু অনিবার্যভাবেই ঘোরলাগানো প্রবহ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যেমন তাঁর মহাকাব্যিক আয়তনের উপন্যাসে গল্প শুধু বলেনই না, বরঞ্চ তিনি গল্পের পর গল্প বুনে চলেন, ঠিক তেমনি ভিসেন্তে আলেকজান্দ্রেও তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প ও রূপক উভয়কে বুনেই চলেন বটে। আর বুনতে থাকেন এমনভাবে যে, তিনি উপমার উপমা এবং রূপকের রূপক হাজির করতে থাকেন একের পর এক। যেমন তিনি হৃদয়কে তুলনা করেন সূর্যের সঙ্গে, যে সূর্যকে তিনি তুলনা করেন আগ্নেয়গিরির সঙ্গে, আবার যে আগ্নেয়গিরিকে তুলনা করেন অগ্নিঝরা মেঘের সঙ্গে, আবার সেই মেঘকে তুলনা করেন জমাটবাঁধা হরফের সঙ্গে ইত্যাদি। এভাবেও বলা যায়, তিনি কবিতায় তাক-লাগানো উপমান-উপমেয়ের সম্পর্কের এক অনবদ্য কাব্যিক ‘ক্যালকুলাস’ রচনা করেন অসাধারণ দক্ষতায়; অর্থাৎ কবিতায় চালুকরা একটি নির্দিষ্ট আলংকারিক মুহূর্তে যা উপমান থাকে তা পরে নিজেই হয়ে ওঠে উপমেয় এবং আবার যা থাকে উপমেয় তা হয়ে ওঠে উপমান। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে আমরা যাদের ‘ব্যতিরেক’ এবং ‘প্রতীপ’ বলে থাকি তাদের দুর্দান্ত ব্যবহারও লক্ষ করা যায় আলেকজান্দ্রের কবিতায় : অর্থাৎ আলেকজান্দ্রে সেই কাব্যিক মুহূর্ত তৈরি করেন যখন উপমেয়ের লেবাসে আসলে উপমানই কল্পিত হয় এমনভাবে যে, উপমেয় নিজেকে ফলাও করে হাজির করতে গিয়ে উপমানকেই গায়েব করতে চায়। আলেকজান্দ্রের কবিতা থেকে পঙতি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিস্তর উদাহরণ দেওয়ার অবকাশ এই ভূমিকার পরিসরে না থাকলেও নিচের অনুবাদগুলোতে আশা করি আলেকজান্দ্রে’র উপমান-উপমেয়ের সম্পর্কের কাব্যিক ক্যালকুলাসকে পাঠক খেয়াল করতে পারবেন। এখানে এও বলে রাখি, বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে এমন একজন কবি যাঁর কবিতা থেকে কিছু লাইন আলাদা করে তাঁর শৈলীর আস্বাদ গ্রহণ সবসময় যুৎসই ঠেকে না; বরঞ্চ তাঁর কবিতার পুরোটাই আমাদের পড়তে হয় এবং তিনি কবিতায় যে ঘোর সচরাচর তৈরি করেন সেখানেও প্রবেশ করতে হয়। এখানে এ কথাটা জোর দিয়েই বলে নেওয়া দরকার যে, কবিতায় ঘোর তৈরি করাও বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

এই ঘোর তৈরি করার ক্ষেত্রে অবশ্য বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের নিজস্ব সাংগীতিকতাও ভূমিকা রেখেছে, যদিও এও সত্য যে, মালার্মে এবং ভালেরির দেখানো পথে আলেকজান্দ্রে কবিতাকে সংগীতের পর্যায়ে তুলতে চান নাই। তবে তাঁর সাংগীতিকতা প্রথমত জারি থাকে তাঁর লম্বা লাইন এবং ছোট ছোট লাইনের পালাবদলে। সত্য, কবিতায় তিনি দীর্ঘলাইন ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। তা তিনি ব্যবহার করেছেন বেশ স্বচ্ছন্দেই এবং সাফল্য সহকারেই। কেননা, তিনি এই দীর্ঘ লাইনগুলোকে দিতে পেরেছেন যেন ধীরে বয়েচলা জলস্রোতের সাংগীতিকতা। আবার ছোট ছোট লাইনগুলোতেও তিনি চিহ্নের ও ধ্বনির সম্পর্কের সাংগীতিকতা রচনা করেছেন। এছাড়া তার চিত্রকল্পের স্থাপত্য মাঝেমধ্যে নিজেই হয়ে ওঠে– গ্যেটের ভাষা ব্যবহার করে বলতে গেলে—‘ফ্রোজেন মিউজিক’ বা জমাটবাঁধা সংগীত। এই সংগীত আবার গলেও যায়, যখন দেখি তিনি কবিতায় কিছু পুনরাবৃত্তি এবং মোটিফকে ব্যবহার করেন রেটরিকাল কৌশল হিসেবে। এও বলা দরকার, তাঁর লম্বা লাইনগুলো মাঝেমধ্যে গড়িয়েও চলে; এখানেও থাকে সাংগীতিকতা। আবার তাঁর ছোট ছোট লাইনগুলো হঠাৎ থেমেও যায়; এই যতি যে নৈঃশব্দ্য সঞ্চারিত করে সেখানেও নিহিত থাকে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের সাংগীতিকতা। এখানে জোর দিয়েই বলা দরকার, বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের অধিকাংশ কবিতায় লাইনের দারুণ অসম বিন্যাস বিশেষভাবে চোখে পড়ে। আর ‘ফ্রী ভার্স’ নিয়ে তিনি পরাবাস্তববাদী কায়দায় প্রচুর পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। যেমন– তিনি লিখেছেন বেশ কিছু ‘গদ্যকবিতা’, যদিও তাঁর পছন্দের প্রধান—একমাত্র না হলেও—ফর্ম হিসেবে লিরিককেই অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়।

এবারে আসি বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের রাজনৈতিকতা প্রসঙ্গে। তাঁর ভক্তদের কেউ কেউ জোরেশোরেই বলে থাকেন যে, তিনি মোটেই রাজনৈতিক নন। এখানে আমার প্রিয় লেখক জেমস জয়েসের সঙ্গে পুরোপুরি সংহতি জানিয়ে আমিও একটা কথা জোর দিয়েই বলতে চাই। জানি, কথাটা রাজনীতিবিমুখ এবং রাজনীতি-না-বোঝা বিশুদ্ধতাবাদীদের পছন্দ হবে না। কথাটা জয়েসেরই। প্রতিটি কবিতাই তো একেকটা বিদ্রোহ; যা কিছু থাকে তার বিরুদ্ধেই কবিতা যেন বিদ্রোহ করে। এভাবেও বলা যায়, কবিতা অন্তর্গতভাবেই রাজনৈতিক; প্রধানত এই অর্থে যে, সে বিরাজমান ভাষিক ক্ষমতাসম্পর্ককে বা আধিপত্যকেই কোনো না কোনোভাবে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে, যেমন সে সনাতন বাস্তবতাকেও চ্যালেঞ্জ করে। এই অর্থে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক, যে অর্থে ফরাসি পরাবাস্তববাদীরা রাজনৈতিক ছিলেন, যদিও আলেকজান্দ্রে কেবল পরাবাস্তববাদীই ছিলেন না। এখানেও এও যুক্ত করা দরকার যে, গত শতকের তিরিশের দশকে (১৯৩৬-৩৯) স্পেনে যে গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, সেখানে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে সাহস আর সততার সঙ্গেই স্পষ্টত ফ্রাঙ্কোবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন, যে অবস্থান তাঁর বেশ কিছু কবিতায় প্রায় সরাসরি উপস্থিত হয়েছে, কবিতার নান্দনিকতাকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ না করেই। আর তাঁর জোরালো ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থানের কারণেই স্পেনে সেই সময় তাঁর কবিতা বাজেয়াপ্ত হয়। এও বলা দরকার, তিনি আবার সেই সময়ের দুর্দান্ত বিপদসঙ্কুল স্পেন ছেড়ে অন্যদের মিতো যাননি অন্য কোথায়ও; আসলে সারাজীবনে স্পেনের বাইরে তিনি যাননি বললেই চলে, যেমন সারাজীবনে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে বিয়েও করেননি। এছাড়া প্রায় সারাজীবনই তিনি ভুগেছেন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত, বিশেষ করে কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতায়।

এবারে অনুবাদ নিয়ে দুয়েকটি কথা। ‘অনুবাদকেরা বিশ্বাসঘাতক’—এই পরিচিত ইতালীয় প্রবাদের ভূত আমাকে যে তাড়া করে না, তা নয়। তবে এই ভূত ঝাড়ার ক্ষেত্রে সালমান রুশদির একটা উচ্চারণও বেশ কাজে লাগে : যদি অনুবাদে কিছু হারিয়েই থাকে, অনুবাদে আবার কিছু পাওয়াও যায়। এই পাওয়াটা খারাপ হতে পারে, ভালোও হতে পারে। সেটা তো এক ধরনের বিচারের বিষয়। তবে আমি মনে করি যে, বিশেষ করে কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে শতকরা একশ ভাগ বিশ্বস্ততা বলে কিছু নেই। বিশ শতকের অন্যতম অনুবাদতাত্ত্বিক ওয়ালটার বেনজামিনের এ কথাটাও মানি : “অনুবাদ একটি ফর্ম।”

অর্থাৎ মূলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই অনুবাদ ফর্ম হিসেবে তার আপেক্ষিক সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে। সচরাচর বলা হয়ে থাকে যে, যা কিছু অনুবাদে হারায় তাই তো কবিতা। সোজা কথায়, কবিতার অনুবাদ হয় না। কিন্তু বেনজামিনের সুবাদে এও বলা যায় যে, কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার অনন্ত অনুবাদযোগ্যতা। একটা কবিতা তো অনেকভাবেই এবং অনেক সময় ধরেই অনূদিত হতে থাকে। আর বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে মনে হয়েছে যে, তাঁর কবিতা বিভিন্নভাবেই অনূদিত হতে পারে। এও মনে হয়েছে, তাঁর কবিতা আরও কবিতা উস্কে দেয়। তিনি কবিতা-উস্কে-দেওয়া কবিতা লিখেছেন, যা অনুবাদ করতে গিয়ে আমি যে একেবারে স্বাধীনতা নেইনি তা নয়। মাঝেমধ্যে কবির বিশেষ বিশেষ ‘মুড’ ও ‘টোন’-কে বাংলায় ধরতে গিয়ে বাধ্য হয়ে আমাকে মূল কবিতার লাইনবিন্যাস খানিকটা পাল্টাতে হয়েছে, যেমন আবার অনুবাদে ঘটেছে যতিচিহ্নের ভিন্ন ব্যবহার। এক্ষেত্রে আমাকে বাংলা ভাষার কিছু দাবিও মেটাতে হয়েছে বটে।

সবশেষে কবির নামের বানান এবং উচ্চারণসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একটু না বললেই নয়। আমি নিজেই কবির নাম অন্যত্র লিখেছি এভাবে— ভিসেন্তে আলেইহান্দ্রে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য আমি প্রভাবিত হয়েছি ওই নামের ইংরেজি এবং ‘চিকানো’ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মেক্সিকান’ অধিবাসী) উচ্চারণের দ্বারা। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় সচরাচর যেভাবে সেই নাম উচ্চারিত হয়, তার কাছাকাছি আসে এই বানান—বিসেন্তে আলেকজান্দ্রে—যদিও এও সত্য যে, স্পেন এবং লাতিন আমেরিকা জুড়ে স্প্যানিশ ভাষায় বিভিন্ন শব্দ এবং নামের উচ্চারণ মোটেই অভিন্ন নয়। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। তো, পড়ুন আমার অনুবাদে বিসেন্তে আলেকজান্দ্রের কবিতা। কবিতাগুলো নির্বাচিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে।

বন্ধ

উদোম পৃথিবী। নিরাপত্তাহীন রাত
নিরিবিলি। বাতাস তার ঝালরের
বিপরীতে ইঙ্গিত দেয়
কানহীন ধুকধুক ধুকধুক।

সিসা ছায়া ঢালে, হিম,
ভারি সিল্কে জড়িয়ে রাখে
তোমার বুক, কালো,
রুদ্ধ। অতএব সবকিছু

চাপে থাকে রাত্রির
ধাতবে। প্রসিদ্ধ, শান্ত,
রাতের স্বচ্ছ পুরনো
সমতলের উপর।

দেউলিয়া নক্ষত্রেরা থাকে।
ঘষামাজায় মসৃণ কবজা। বরফ
ভেসে চলে উচ্চতায় উচ্চতায়
শৈত্যের ধীর প্রবহ।

নির্বাক নিবিড় বিন্যাসের উপর
ভেসেচলা ছায়া
আঘাত হানে, কঠোর সংযমী
তার গোপন চাবুক।

বেতের প্রহার। রক্তের কিংবা আলোর
কিংবা আগুনের প্রবাল দিব্য উদঘাটিত হয়
পাতলা স্বচ্ছ রেশমি বসনের নিচে,
তারপর সে কর্বুর হয়ে পথ ছেড়ে দেয়।

গভীরভাবে প্রবেশ কর মাংসে কিংবা মাংসের
আলোতে। বাতাস বেঁচে থাকে কেননা সে
অপেক্ষা করে ঝাপটানির,
পাল্টা-স্রোতের, যতির, নৈঃশব্দের।
(১৯২৮)

আমার কণ্ঠস্বর

আমি জন্মেছিলাম এক গ্রীষ্মের রাতে
একজোড়া যতির মাঝখানে। কথা কও : আমি শুনছি।
আমি জন্মেছিলাম। যদি শুধু দেখতে কী করে
চেষ্টা ছাড়াই জোছনা শুধু দুঃখ দেখায়।
আমি জন্মেছিলাম। সুখ ছিল তোমার নাম।
জেল্লাদার আলোর নিচে একরত্তি আশা, একটা পাখি।
পৌঁছে যাচ্ছে, পৌঁছে যাচ্ছে। সমুদ্র ছিল কেবল নাড়ির স্পন্দন,
একটি হাতের তালু, একটি উষ্ণ মেডেল।
তাই তারা সবাই সম্ভব এখন : আলোকসম্পাত, আলিঙ্গন,
আবরণ, দিগন্ত, যারা সবাই কথা বলে শব্দের সঙ্গে,
যে শব্দের কোনো অর্থ নেই, যে শব্দ ঘুরপাক খেতে থাকে
শ্রুতির মতো কিংবা সমুদ্রের নুড়ির মতো
যা আবার ভোরের মতো ফুটে বেরোয় (শোনো, শোনো)
আমাদের পায়ের ছাপমারা আলোতে।
(১৯৩২)

এসো, সবসময়ই এসো

এত কাছে এসো না। তোমার মুখ, তোমার অগ্নিময় মুখ,
তোমার দপ-করে-জ্বলা মুখ, চুম্বনের চিহ্নপথ,
সেই দহন আমি অনুভব করি এমনকি জ্বলজ্বলে দিনের বেলায়,
যখন তুমি কাছে আসতে থাকো, সেই ছোঁয়াচে দীপ্তি, যা
আমার হাতে আবাস গড়ে, সেই জ্যোতির্ময় নদী যেখানে
আমি আমার বাহু দুটো ডুবালেও তার জল পান করা থেকে
বিরত থাকি পরবর্তী তেজোময়তার কঠিন জীবনের ভয়ে।

আমি চাই না তুমি আমার মধ্যে আলোর মতো বাস করো,
সেই আলোর সঙ্গে আগেই এক-হয়ে-যাওয়া নক্ষত্রের নির্জনতা নিয়ে,
যাকে প্রেম প্রত্যাখ্যান করে কঠোর নীল মহাকাশ জুড়ে,
যা বিচ্ছিন্ন করে, দূরে চলে যায়, আর মিলতে চায় না কখনও,
যেখানে প্রতিটি দুর্গম আলোকচ্ছটা একেকটা গাঢ় নির্জনতা যেন
যে নির্জনতা বিলাপ করতে থাকে তার বিষণ্ণতার দ্যুতি ছড়িয়ে।
নির্জনতা ঝিলিক মেরে ওঠে প্রেমহীন পৃথিবীতে।
জীবন এক দীপ্তিমান আচ্ছাদন,একটি বন্ধুর কিন্তু স্থির আবরণ,
যেখানে মানুষের কোনো বিশ্রাম নেই, যতই সে তার ঘুমকে
প্রয়োগ করুক একটি কৃষ্ণায়িত নক্ষত্রে।

কিন্তু এর চেয়ে বেশি কাছে এসো না। তোমার দীপ্তিমান মুখ
একটি তরতাজা অঙ্গার, যা আমার চেতনাকে ঘুমের অতল থেকে জাগিয়ে তোলে,
থাকে জ্বলজ্বলে যন্ত্রণা যেখানে মরে যাওয়ার লোভ পেয়ে বসে আমায়,
দারুণ ইচ্ছা হয় তোমার অটল ঘর্ষণে আমার ঠোঁট দুটোকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে
ছারখার করে দিতে, যেমন ইচ্ছে করে তোমার জ্বলন্ত হীরকের আলিঙ্গনে
আমার মাংস গলিয়ে দিতে।

এত কাছে এসো না, কারণ তোমার চুম্বন চলতে থাকে এবং
চলতেই থাকে নক্ষত্রদের অসম্ভব পারস্পরিক সংঘর্ষে,
সেই স্পেসের মতো যেখানে হঠাৎ করে আগুন ধরে,
সেই উর্বর ইথারের মতো যেখানে তাবৎ পৃথিবীর ধ্বংস
হয়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট হৃদয়, যা ভালবাসায় নিজেকে
জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে।

এসো, এসো, এসো হিম অন্ধকারে অঙ্গারের মতো
যে অঙ্গার একটি মৃত্যুকে ধারণ করে;
এসো অন্ধ রাত্রির মতো, যে আমার দিকে তার মুখ ফেরাতে থাকে;
এসো ওষ্ঠজোড়ার মতো, যারা চিহ্নিত হয়ে থাকে রক্তাভায়,
এসো দীর্ঘ রেখার মতো, যে রেখা সকল ধাতুকে ঐক্যবদ্ধ করে।

এসো, এসো, হে প্রিয়তমা; এসো সন্ন্যাসী মুখ, প্রায় ঘুরতে থাকা বৃত্তময়তা
যা জ্বলজ্বল করে একটি অক্ষের মতো, যার মৃত্যু নির্ঘাৎ আমার বাহুতে;
এসো দুটো চোখের মতো, এসো দুটো অতলস্পর্শী নির্জনতার মতো,
এসো এখনও নাম-না-জানা গভীরতা থেকে জরুরি আহবানের মতো।

এসো, এসো, মৃত্যু, এসো প্রেম; তাড়াতাড়ি এসো, আমি তোমাকে ধ্বংস করব
এসো, আমি মারতে কিংবা মরতে কিংবা ভালোবাসতে চাই
এসো, আমি তোমাকে সবকিছু দিতে চাই, সবকিছু
এসো একটি ভারবিহীন পাথরের মতো ঘুরতে ঘুরতে, এসো
এসো একটি বিভ্রান্ত চাঁদের মতো, যে চাঁদ আমারই আলো চায়।
(১৯৩২)

জোছনা অথবা গিটার

জোছনার মতো এক গিটার।
ওটা কি জোছনা নাকি শুধু তার রক্ত?
একটি ছোটো হৃদয় পালিয়ে গেছে,
চলে গেছে বনের উপর, তার নীল নির্ঘুম সংগীত বাজিয়ে।

একটি কণ্ঠস্বর নাকি তার রক্ত
একটি তুমুল আবেগ নাকি তার সন্ত্রাস
একটি মাছ নাকি শুকিয়ে যাওয়া চাঁদ
যা ধপাস করে পিছলে পড়ে রাতে, পাহাড়ের গায়ে ছায়া ছিটিয়ে।

অদ্ভুত হাত নাকি হুমকি দেওয়া ক্রোধ।
জোছনা রক্তিম নাকি সে হলদে?
না, সে তো নয় আক্রোশে রক্তলাল হয়ে ওঠা
কোনো চোখ যা দেখে নিতে চায় ক্ষুদে পৃথিবীর কিনারা সব।

সেই হাত যা আকাশ জুড়ে জীবন খোঁজে
যা রক্তঝরা দিগন্তের হৃদস্পন্দন খোঁজে
যা আদিম গ্রহগুলোর মাঝখানে গভীরভাবে খোঁজে
সেই হাত অনুভব করে রাতে জ্বলজ্বল করা গিটারের অনুপস্থিতি।

কষ্ট—বুকের কষ্ট—যা কোনো বয়ানে ধরা যায় না
যখন বুনো জন্তুরা অনুভব করে তাদের চুলের খোঁচা
যখন তারা অনুভব করে তারা ভিজে আছে সমাহিত আলোতে
যে আলো তাদের হাড় খুঁজতে থাকে একটি দুর্দান্ত বিশাল হাতের মতো।
(১৯৩৬)

স্বপ্নেরা

নিঃসঙ্গতার ওইসব মুহূর্ত আছে
যখন অবাক হৃদয় অনুভব করে, প্রেমের
কোনো অনুভূতি নেই তার। আমরা শুধু বসে থাকি,
ক্লান্ত, দিনমান উপচে পড়ে অন্ধকার।

কেউ একজন এখন ঘুমাচ্ছে ওই বিছানায়, শিশুর মতো।
কিন্তু আমরা হয়তো ঘুমিয়েই আছি…না, আমরা গতিময়।
এবং আমরা বিষণ্ণ, নিঃশব্দ। বাইরে অবিচলিত বৃষ্টি।
অলস অবিশ্বাসী কুয়াশার এক সকাল। এত একা!
জানালার বাইরে চেয়ে থাকি। স্তূপ হয়ে থাকে বস্ত্র,
ভারী বাতাস; তবলার বোল তোলে বৃষ্টি। আর ঘরটা
বরফ হয়ে থাকে এই বর্বর শীতে যা বাহির থেকে ভিন্ন লাগে।

তাই তুমি চুপ করে থাকো, তোমার হাতে থাকে তোমার শির।
টেবিলে তোমার কনুই। চেয়ারটা শব্দহীন।
আর নিঃশ্বাসের পতন ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই,
সেই যে নারী, সমাহিত ও সুন্দর, ঘুমায় সেখানে—
সে স্বপ্ন দেখে, তুমি তাকে ভালোবাস না
সে স্বপ্ন দেখে, তুমি তার স্বপ্ন।
(১৯৫৪)

তার দেওয়া হাত

আরও একবার আমি ছুঁয়ে যাই তোমার হাত,
তোমার ওমভরা হাত, নিকষিত ও শিষ্ট হাত
মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করে আমি তাকে আঘাত
করতে থাকি বিনম্র, তাকে আলতোভাবে স্পর্শ করি,
তার আকার অনুভব করার জন্য, তার আঙ্গিক ছুঁয়ে
যাওয়ার জন্য, পাখাসহ তার চামড়া যার নিচে থাকে
উৎকোচ-উপেক্ষা-করা পাথুরে দেহসার, বিষণ্ণ অস্থি
যা কখনও পায়নি প্রেম। আহা, কী দুর্দান্ত ভালোবাসায় ভিজে
থাকে মধুর মাংস।

সাক্ষাৎ উত্তাপ ছড়াতে থাকে তার কণ্ঠস্বর, তার বিনীত বাসনা
আওয়াজ তোলে তোমার গোপনীয়তায়, লুকিয়ে থাকা চামড়া খুলতে শুরু করে;
তার ভেতর দিয়ে তোমার বলকানো রক্তে পিছলে যায় আমার কণ্ঠস্বর
যেখানে সে এলোমেলো পথ হাঁটে, ভাসে তোমার গোপন সরোবরে,
যেন দ্বিতীয় রক্ত গেয়ে চলেছে ছায়া-ছায়া গান, অমৃতের মতো অন্ধকারময়
সে তোমায় ভেতর থেকে চুমু খায়, তোমার দেহে সে বয়ে যায় একটি স্বচ্ছ
টংকার হয়ে —সে এখন আমার দেহের প্রতিরব, যখন আমার দেহ ভরে যায়
রবরবা কণ্ঠস্বরে। আহা, তোমার প্রতিধ্বনিময় দেহকে জড়িয়ে নেয়
আমারই আওয়াজ।

তাই জেনে গেছি যখন আমি তোমার হাত ছুঁয়ে যাই
কেবল তোমার অস্থি আমার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে—
সেই দীপ্তিমান মানবঅস্থি। আর জানি তোমার ভেতরে
আছে এক বিষণ্ণ বিন্যাস, যা আমাকে গ্রহণ করে না,
যখন তোমার মাংস মুহূর্তের জন্য শাদা উষ্ণতায় দপ করে ওঠে,
তোমার হাতে অলস আঘাতে জেগেওঠা আগুনকে জড়িয়ে
তোমার সিল্কভরা ছিদ্রময় হাত শুরু করে তার বিলাপ,
তোমার নরম শান্ত হাত যেখানে আমি আসতে থাকি
ধীরে ধীরে, বেশ ধীরে, চুপে চুপে, তোমার জীবনে,
যেতে থাকি রক্তের সমস্ত গভীরতম প্রবহের দিকে
যেখানে আমি ভাসতে থাকি এবং বাস করি আর
তোমার ভেতরে আমি আমার গান গেয়ে তার ইতি টানি।
(১৯৫৪)


প্রেম এবং তারপর

যেহেতু সেখানে তুমি শুয়ে থাকো কক্ষের ছায়ায়
সমস্ত শীৎকার শেষে বিরাজমান নৈঃশব্দের মতো
আমি আমার আধো ঘুমের অতল থেকে ধীরে জেগে উঠি
তোমার নরম শীতল-করা দেহের কিনারায় যা এখনও
কী দারুণ অস্তিত্বমান।
আর আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে যাই তোমার বিনম্র বহির্সীমানা,
তোমার ফিরিয়ে-নেয়া জীবনের ছোটো ছোটো আঁচড়, ছড়ানো রেখা।
আমি অনুভব করি তোমার দেহের নিঃশব্দ সঙ্গীতময় সত্য
যা একটি মুহূর্ত আগেও
নৈরাজ্যময় আগুনের মতো গান গেয়েছিলো।
এবং তোমার আধো মুখ মাটির মৌ মৌ জাগিয়ে তোলে
যা নাকি হারিয়েছিলো
তার চিরায়ত চেহারা প্রেমের খেলায়, যা নাকি আকাশের দিকে
জেগেছিলো পিপাসায় ছটফট-করা ঝাঁঝালো আগুনের মতো
তার আদিম আঙ্গিকে তাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য
যে আঙ্গিক পুনর্গঠিত হয় তার আবরণে।
এক প্রেমিকার উত্তপ্ত, রেশমী, খাতহীন, বিনম্র, নগ্ন প্রান্ত
স্পর্শ করে আমরা জেনেছি তার জীবন-প্রবহের কথা।
প্রেম একটি মুহূর্তের ঝলকানিতে ধ্বংসের উল্লাস
একটি পুড়ে যাওয়ার কীর্তিকলা
যা আমাদের ভালোবাসার বিশুদ্ধ নারীকে সন্ত্রস্ত করে,
যে নারী আমাদের আগুনে আহত হয়
কিন্তু তার দেহ থেকে নিভুনিভু আগুন সরিয়ে নেয়ার পর
এবং দৃষ্টিতে তাকে রেখে আমরা দেখি স্বচ্ছ একটি নতুন
পুনর্গঠিত জীবন
প্রশান্ত ওম-ভরা জীবন, যা আমাদের হাতছানি দিয়েছিলো
তার দেহের অনুপম উপরিভাগ থেকে।
এখানে আছে প্রেমের বিশুদ্ধ পাত্র, ভরপুর,
যার সমাহিত দ্যুতি-ছড়ানো সোনালী রক্ত উপচে পড়ে।
এখানে আছে স্তনজোড়া, পেট, বৃত্তের ঘূর্ণির মতো উরু
নিচে তার পা দুটো।
এবং ওপরে তার কাঁধ, তার কণ্ঠ যেন এক নতুন পালক,
তার চিবুক ঝলসানো নয়, দগ্ধ নয়, কিন্তু তাজা গোলাপের আভায়
অকুণ্ঠ প্রকাশমান এবং তার কপালে আমাদের প্রেমের প্রাত্যহিক ভাবনা
ঘরবাড়ি গড়ে তোলে।
এবং চোখ খোলা রেখে সতর্ক থাকে।
এবং তার দীপ্তি-ছড়ানো মুখ ছাপিয়ে, যে মুখ হলুদ সন্ধ্যার
প্রাঞ্জল ওম, নির্ঝঞ্ঝাট উষ্ণতা
কেন্দ্রস্থল হয়ে থাকে তার মুখ, ছিন্ন কিন্তু আলোক-বিশুদ্ধ
অগ্নিউৎসবে একটি বিনীত প্রবেশ-পথ।
আমার এই সন্ত্রস্ত ও সচেতন আঙ্গুলগুলো দিয়ে
আমি তোমার চামড়া ছুঁয়ে যেতে থাকি
যখন আমার মুখ তোমার শীত-শীত চুলকে আচ্ছন্ন করতে থাকে।
(১৯৫৪)


বিস্ফোরণ

আমি জানি এসব কিছুরই নাম আছে, জীবনদায়ী নাম।
প্রেম তো নয় বোমার বিস্ফোরণ, যদিও একই সঙ্গে প্রেম
তাও হতে পারে। প্রেম এক তুমুল বিস্ফোরণ যা থাকে
সারাটা জীবন। প্রেম আসে ভাঙনের সেই লগ্ন থেকে
যাকে আত্মাবিষ্কারের মুহূর্তও বলা চলে। তারপর
প্রেম নিজেকে খুলতে থাকে, খুলতে থাকে আরো তীব্রতায়
সূর্যালোকের ক্ষিপ্র মেঘের মতো গায়ে রং ছিটিয়ে, যে সূর্যালোক
সময়ের ভেতরে ঘুরপাক খেতে খেতে আর ভেসে ভেসে পরিপক্ক হয়
জীবনের প্রবহে, যাতে একটি বিকেল হয়ে ওঠে সমস্ত অস্তিত্ব,
অথবা আরও ভালো : সমস্ত অস্তিত্বই হয়ে ওঠে এক দীর্ঘ বিকেল,
প্রেমে পরিপূর্ণ ঘরের মতো একটি বিকেল, যেখানে হঠাৎ জড়ো হয়
মহাজগতের সব আলো, হঠাৎ সারাজীবনেই, যতক্ষণ না পর্যন্ত
তারা সম্পূর্ণ হয়, পুনর্গঠিত হয়, পুষ্ট হয়; আর সেখান থেকে
সবচেয়ে ভরাট আলো নেমে আসে নিচে, যা পাল্টা ঘুরতে থাকে
আর নিজেকে খুলতে থাকে জীবন-ভাসিয়ে-রাখা বিপুল স্রোতের মতো,
একটি বিস্তীর্ণ আলোকসম্পাতের মতো, যা আমাদের উভয়কে
উভয়ের দিকে চেয়ে থাকতে বলে।

আমরা আমাদের আত্মার সূক্ষ্মতম অনুপুঙ্খ মেপে দেখেছি।
হ্যাঁ, আমরা সেই প্রেমিক-প্রেমিকা যারা এক বিকেলে প্রেমে পড়েছি।
আমরা সেই আত্মার খবর নিয়েছি ধীরে ধীরে, সবসময়
বিস্মিত হয়েছি পরের সকালে তাকে আরও ব্যাপ্ত দেখে।
একইভাবে সেই বিকেলে প্রেমিক-প্রেমিকা শুয়ে থাকে
দারুণ নগ্নতায়, তারা তাদের উদ্ভাসিত দেহের খবরাখবর রাখতে থাকে,
তারা নিজেদের ভেতরে মগ্ন থাকে আর সেই বিকেলেই সব আলো
ফুটে বেরুতে থাকে, বাড়তে থাকে, এভাবে গড়ে ওঠে
ভালোবাসার এক অন্তহীন বিকেল। তারপর তারা সকলেই
অন্ধকারে হারিয়ে যায়। এরপর তারা একে অপরকে আর দেখবে না,
একে অপরকে চিনবে না কখনও…

কিন্তু আমাদের দীর্ঘ বিকেল থাকে সারা জীবনের সমান হয়ে।
আমরা পরস্পর পরস্পরকে জীবন দান করি, যেন বা আমরা
শুয়েছিলাম পাশাপাশি। আর তোমার আত্মা, হে প্রিয়তমা,
এই জীবনদায়ী স্থানে জায়গা বদলে ভেসে এল, যে আত্মা
একটি বিশাল দেহের মতো, যা সঁপেছি নিজেকে এক অফুরন্ত বিকেলে।
সেই বিকেলের প্রতিটি মুহূর্তে আমি তোমায় ভালোবেসেছি;
আর এমন তো নয় যে, সূর্যাস্ত নিজেই কেবল ঢলে পড়ছে সেখানে;
সমস্ত জীবনেরই পতন সেখানে; জীবন ফুরিয়ে আসছে এবং
আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি তোমায় ভালোবাসি।
এই বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে—এই বিলাসী বিপুল নিঃশ্বাসস্পন্দিত বিকেল
যেখানে আমরা দুজন ভালোবেসে শরীরে শরীর মিলিয়েছি।
পুরো জীবনটাই চলে গেল একটি বিকেলের মতো।
মনে হল, বয়ে-যাওয়া বছর সব একটি ঘণ্টা মাত্র, যখন আমি
তোমার আত্মায় প্রবেশ করেছি, ধীরে ধীরে তাকে অনাবৃত করে,
মুহূর্তে মুহূর্তে তাকে ভালোবেসে, কেননা সেখানে ঘটনার ভেতর দিয়ে
যা নিঃশেষিত হচ্ছে, তাই তো হতে পারে জীবন, সেটাই জীবন।
কিন্তু শুরুর ঝিলিকটা ফুরিয়ে যাচ্ছে এখানে। এবং এখন।
আর তুমি তোমার পরিপক্কতায় ও স্ফুলিঙ্গে সম্পূর্ণ প্রকাশিত
এবং সেটা ছিল একটি বিকেল, একটি ভেঙেপড়া ঢেউ,
একটি শিখর। শীর্ষের আলো সব খুলে গেছে। আর
তুমি এই মুহূর্তে এখানে যখন আমরা একে অপরকে পেয়ে গেছি।
(১৯৫৪)

বৃষ্টি হচ্ছে

এই সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছে, আর তোমার যে ছবিটা
তুলেছিলাম তাও ঝরছে আজ বৃষ্টি হয়ে।
দিনটা হুট করে খুলে যায় আমার স্মৃতিতে।
ভেতরে হেঁটে আসো। অথচ আমি কোনো আওয়াজ পাই না।
স্মৃতি আমাকে তোমার ছবি ছাড়া দেয় না তো কিছুই।
সেখানে কেবল তোমার চুম্বন ঝরছে, অথবা ঝরছে বৃষ্টি।
তোমার কণ্ঠস্বর বৃষ্টি হয়ে ঝরছে
তোমার বিষণ্ণ চুম্বন বৃষ্টি হয়ে ঝরছে
গভীর চুম্বন, বৃষ্টিতে ভেজা চুম্বন। ভেজা ভেজা ঠোঁট।
স্মৃতিতে ভিজে ভিজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে চুম্বন
কোনো এক ছাইরং মোলায়েম আকাশ থেকে।
তোমার প্রেম থেকে ঝরে বৃষ্টি, আমার স্মৃতিকে
ভিজিয়ে দিয়েই বৃষ্টি পড়তেই থাকে। অনেক নিচে
চুম্বন পড়ে। ধূসর বৃষ্টি
ঝরেই চলেছে।
(১৯৬৮)

বৃদ্ধ মানুষটা মুসার মতো

মুসার মতো পাহাড়ের চূড়ায়।

প্রতিটি মানুষ সে রকম হতে পারে
এবং শব্দের জন্ম দিতে পারে
এবং তার দুই বাহু শূন্যে তুলে ধরতে পারে
এবং অনুভব করতে পারে কীভাবে আলোর বিচ্ছুরণ
তার মুখমণ্ডল থেকে পুরনো পথের ধুলাবালি ঝেড়ে ফেলে।

কেননা সূর্যাস্ত সেখানে ফুরিয়ে গেছে।
তার পেছনে তাকিয়ে থাকে ভোরবেলা।
সামনে : বাড়ন্ত ছায়ারা। আর রশ্মিগুলো
চকচক করা শুরু করে।
আর সে তার বাহুকে দোলাতে থাকে
এবং নিজের মৃত্যুর একেবারে ভিতর থেকে
জীবিতের পক্ষে সে একা কথা বলে।

কারণ মুসার মতো সে মৃত্যুবরণ করে
অকেজো ফলক আর বাটালি সঙ্গে নিয়ে নয়
পাহাড়গুলোতে জ্বলেওঠা বিদ্যুৎ সঙ্গে নিয়ে নয়
তবে সঙ্গে থাকে মাটির উপর ভেঙেপড়া শব্দরা
সঙ্গে থাকে তার আগুনধরা চুল, তার কানের লতি
যাকে গানের কথায় কাঁপিয়ে রাখে আতঙ্ক-ছড়ানো শব্দ সব
আর তার চোখে নিঃশ্বাস থাকে এখনও
ফুসফুসে স্ফুলিঙ্গ
আর মুখ ভরে থাকে আলোতে।

একটি সূর্যাস্ত মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।
দিগন্তের কিনারায় একটি ছায়ার ভালোবাসা।
তারুণ্যের আর তৃষ্ণার আর কণ্ঠস্বরের একটি সম্ভার।
এবং সেই জায়গায় প্রজন্মের পর প্রজন্মের উপস্থিতি
আসন্ন। পৃথিবী : সীমান্তরেখা।
অন্যেরা সেটা দেখতে পাবে।

বৃদ্ধ মানুষটা মুসার মতো পাহাড়ের চূড়ায়।
(১৯৬৮)

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.