জাঁক দেরিদার বিখ্যাত সেই বক্তৃতা ১৯৯৮ সাল। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট ডেইভিস-এর সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল থিয়োরি একটা বিশেষ তাত্ত্ব...

‘টাইপরাইটার রিবনঃ লিমিটেড ইংক’ - আজফার হোসেন

1:19 PM Editor 0 Comments

জাঁক দেরিদার বিখ্যাত সেই বক্তৃতা

১৯৯৮ সাল। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট ডেইভিস-এর সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল থিয়োরি একটা বিশেষ তাত্ত্বিক আলোচনার আয়োজন করেছে। বিষয় ‘সংস্কৃতি ও বস্তুবাদ’।
নির্ধারিত আলোচকদের সংখ্যা অবশ্য বেশি নয়। পশ্চিমা মুলুকের ‘প্রথম’ সারির কিছু তাত্ত্বিক—যাঁদের কাজ আমি বাংলাদেশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়বার ও পড়াবারও সুযোগ পেয়েছি—ওই আলোচনায় যোগদান করেছেন। এঁরা হলেন মার্কিন মার্কসবাদী সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমিসন, নারীবাদী তাত্ত্বিক জুডিথ বাটলার্, ‘উত্তর-মার্কসবাদী’ তাত্ত্বিক আর্নেস্তো লাকলাউ এবং সেই বিখ্যাত ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’ জাঁক দেরিদা।

স্বীকার করি যে, বেশ কয়েক বছর এই ফরাসি তাত্ত্বিক জাঁক দেরিদা নিয়ে আমার তুমুল আগ্রহ ছিল। কিন্তু যতোই সময় গেছে ততোই তাঁর কাজের রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে প্রায় জামিতিক প্রগমনেই আমার প্রশ্ন ও সন্দেহ জেগেছে। সেটি আরেক প্রসঙ্গ। কিন্তু আমার সহপাঠী এইব্ তারাঙ্গো সেই আয়োজনে দেরিদার বক্তৃতা শোনার জন্য আমাকে ধরে বসলো। ‘চলো, ঘুরে আসি। দেরিদাকে চোখে দেখি নাই কিন্তু এবার দেখবো’। এইবের কণ্ঠস্বরে ও উচ্চারণে বেশ উত্তেজনা। তার চোখে আগ্রহের ঝিলিক।

সে-সময় অবশ্য এইব্ তারাঙ্গো তার জগৎ ও জীবনের অনেক বিষয়, অনেক প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ ওই দেরিদা দিয়েই সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিলো। সে কথায় কথায় দেরিদা আউড়ায়। দেরিদা নিয়ে তার জোশ এতোটাই বেড়েছিল যে, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সে একটা দেরিদা প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্র খোলারও চেষ্টা করেছিলো। পরে দেরিদা-ভক্ত এইব্ তারাঙ্গো দেরিদীয় কায়দায় নিজের আগ্রহকেই ‘ডিকনস্ট্রাকট্’ করেছে এই বলে, ‘কিন্তু দেরিদা তো নিজেই কেন্দ্রবিরোধী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী। তাকে নিয়ে আবার কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান কেন?’

ভালো কথা। কিন্তু আমার সহপাঠীর দেরিদীয় পাঠ ও প্রয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই তখন বেশ আতঙ্কিত। এমনকি তার আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই তাকে প্রশ্ন করতে ভয় পেত। কারণ প্রশ্ন করলেই সে ‘দেরিদীয়’ কায়দায়–কথাটা মূলত হিব্টগেনস্টাইন্-এর–বলত, ‘সমস্ত প্রশ্নই কিন্তু প্রশ্ন নয়। একটি প্রশ্নকে প্রশ্ন হয়ে উঠতে হয়’। আসলে ছাত্রছাত্রীদের ভয় পাইয়ে দেয়া ছিল এইব্ তারাঙ্গোর একটা বিশেষ কাজ।

দেরিদার ভক্ত না হয়েও অবশ্য অনেক জায়গায় এবং আমাদের দেশেও কোনো কোনো শিক্ষক বা পণ্ডিত আছেন যাঁরা ছাত্রছাত্রীদের ভয় পাইয়ে দিয়ে বেশ মজা পান। আমার কিছু প্রাক্তন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কিছু শিক্ষক। কোনো বিষয়ে কারো কোনো বক্তব্যের আলোচনা বা পর্যালোচনার চেয়ে ওই সব শিক্ষকের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে কোন্ ইংরেজি শব্দের কোন্ বিশেষ অংশে ‘ভুল’ শ্বাসাঘাত বা ‘এ্যাকসেন্ট’ পড়েছে, সেই বিষয়টি। কিন্তু ‘এ্যাকসেন্ট’ ঠিক করার এইসব এজেন্টকেও—যাদেরকে দেশী সাহেব-মেমসাহেবও বলা যায়—ভয় পাইয়ে দিতে পারে আমার ওই দেরিদা-ভক্ত, কেতাদুরস্ত, দুর্দান্ত সহপাঠী এইব্ তারাঙ্গো। তো, এইব্ তারাঙ্গোর প্রস্তাবে আমাকে সম্মত হতে হলো। শোনা যাক না দেরিদার বক্তৃতা!

এইব্ নিজেই ঠিক করলো সারা রাত নিজের গাড়ি চালিয়েই ওয়াশিংটন স্টেটের পুলম্যান শহর থেকে যাওয়া হবে ক্যালিফোর্নিয়ায়। এইব্ গাড়ি চালায় আর আমি বসে থাকি তার পাশের সিটে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের কথা চালাচালি হয়। সে তার পরিবারের কথা বলে। এক পর্যায়ে জানায়, তার শ্রমিক পিতার সঙ্গে সে আগের মতো করে কথা বলতে পারে না; তাদের দূরত্ব বেড়েছে বেশ। এইবের চোখে-মুখে খানিকটা বিষণ্ণতার ছায়া লক্ষ করি। কিন্তু আমি এক জায়গায় এসে গোল বাধিয়ে দিই; বলি, ‘সেই দূরত্বটা কি বেড়েছে তোমার দেরিদীয় ভাষার কারণে?’ আর যাই কোথায়? দপ করে জ্বলে ওঠে এইব্। কিছুক্ষণ সে মার্কসকে গালিগালাজ করতে থাকে এই ভাব দেখিয়ে যে, মার্কসকে গালিগালাজ করার অর্থ হচ্ছে আমাকেই গালিগালাজ করা!

আমাদের তর্ক শুরু হয়। সে তর্ক চলে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। তর্ক চলাকালীন অবশ্য এইব্ একটা ছোটো শহরের গ্যাস স্টেশনে থেমে গাড়ির জন্য তেল নেয়। এ সময় আরেকটা গোল বাধে। আমি তখন অনেক রাস্তাঘাটই চিনি না। কিন্তু আমি জানি যে, আমার মার্কিন সহপাঠী এইব্ তারাঙ্গোর ওইসব রাস্তাঘাটের ওপর দারুণ দখল। কিন্তু যে গোলটা বাধে, সেটা টের পায় এইব্ নিজেই। তবে বেশ পরে। গ্যাস স্টেশন থেকে বেরুবার পর সে উল্টো পথে ভুল করে প্রায় ১০০ মাইল গাড়ি চালিয়ে এসেছে। এইব্ তর্কে এতোটাই লিপ্ত ছিল যে, সঠিক রাস্তা খেয়াল করার ফুরসত পায় নাই সে। এবার আমি বলে উঠি, ‘এ ধরনের তর্ক আমাদেরকে নিদেনপক্ষে ১০০ মাইল পিছিয়ে দেয়’।

আবারো তর্ক-মুখর হয়ে উঠে এইব্। সে বলে, ‘এগুনো ও পেছানোর মধ্যে বাইনারি বিভাজনগুলো সব সময় সমস্যাদায়ক’। ‘যেখানে আসলেই সমস্যা আছে সেখানে সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া এবং যেখানে সমস্যা নাই সেখানে সমস্যা তৈরি করাই হচ্ছে কিছু ডিসকোর্স-বিলাসী মার্কিন তাত্ত্বিকদের কাজ’—কথাটা বলেছিলেন আমার এক পুর্তোরিকান শিক্ষক ভিক্তর ভিয়ানুয়েভা। কথাটা তখন চট করেই মনে পড়েছিল।

প্রায় আঠারো ঘণ্টা গাড়িতে থাকার পর–অবশ্য একটা শহরে থেমে আমাদেরকে খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে হয়েছিল–আমরা পৌঁছাই ডেইভিস শহরের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায়। চমৎকার সাজানো-গোছানো ক্যাম্পাস। আর গ্রীষ্মের সমস্ত দুপুর যেন উপুড় করে ঢেলে নিয়েছে এই ক্যাম্পাস। আমরা যখন আলোচনার নির্ধারিত স্থানে গিয়ে উপস্থিত হই, তখন ফ্রেডরিক জেমিসন তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতার শেষের দিকে পৌঁছুচ্ছেন। তাঁর বিষয় ছিল ‘স্থাপত্য ও ভূমি নিয়ে জল্পনা’।

আমরা যে কথাগুলো জেমিসনের বক্তৃতা থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম, সেগুলোর মোটামোটি অর্থ হচ্ছে এ রকমঃ আমাদের সময়ের পুঁজিবাদ নগরায়নের ভেতর দিয়ে শুধু ভূমির সমস্যাই তৈরি করে নাই, বরঞ্চ স্থাপত্যের ভেতর দিয়ে খাড়াখাড়িভাবে পুঁজি স্পেসের পর স্পেস দখল করে চলেছে এমনভাবে যে, মানুষ তার আগের জায়গা থেকে সরে এসে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। আরেকটা বিশেষ ‘ফরমুলেশন’ এসেছিলো তাঁর কাছ থেকেঃ সমস্ত বিমূর্তায়নের উৎস হচ্ছে অর্থ।(না, শব্দের বা চিহ্নের অর্থ নয়; এখানে অর্থ হচ্ছে টাকা)।

বলা দরকার, জেমিসন যখন ভূমির সমস্যা নিয়ে কথা বলছিলেন কিংবা এমনকি যখন তিনি গোলকায়নের সময়-ও-স্পেস-সংহারী পুঁজিবাদী লজিকের কথা বোঝাচ্ছিলেন, তখনও তাঁর বয়ানে দুনিয়ার অধিকাংশ জায়গা—এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন অ্যামেরিকা—ভীষণভাবেই অনুপস্থিত ছিল। কালো কবি এ্যালেক্সিস্ নিউন্দাইয়ের একটা লাইন মনে আসেঃ ‘নৈঃশব্দ্য সব করে রব আখ্যানের গভীরে’।

জেমিসনের বক্তৃতার পরেই ছিল একটা ছোট বিরতি। এই সময় কফি খেতে খেতে এইব্ আফসোস করে বলল, ‘খানিকটা দেরি হওয়ায় জেমিসনের পুরা বক্তৃতাটা ধরা গেল না’। যাই হোক, ছাপানো অনুষ্ঠানসূচি থেকে জানা গেলো যে, এরপর থাকবে জুডিথ্ বাটলার্ আর আর্নেস্তো লাকলাউয়ের আলোচনা। আর সন্ধ্যা ৬টায় সমাপনী ভাষণ দেবেন খোদ জাঁক দেরিদা।

বিরতির পর এইব্ আর আমি বাটলার্ ও লাকলাউয়ের সেশনে উপস্থিত হই। বাটলার্ শুরু করলেন ‘দেহ’ নিয়ে এক জটিল আলোচনা। অবশ্যই বলা দরকার যে, দেহ নিঃসন্দেহে প্রকাশের, নিপীড়নের এবং প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ স্পেস। তবে ওই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নটাও আমার কাছে বারবারই ঘুরে-ফিরে আসেঃ কার দেহ? বলাই বাহুল্য, ফুকো-প্রভাবিত বাটলারের উত্তরকাঠামোবাদী দেহতত্ত্ব আর লালনের দেহতত্ত্ব একইসঙ্গে যায় না। বাটলারের অনেক তাত্ত্বিক কথার মধ্যে কয়েকটি মোদ্দা কথা আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। এক, পশ্চিমা আধুনিকতা দেহকে বিভক্ত এবং এমনকি ভাঙচুর করেছে বিভিন্নভাবেই। দুই, তবে নতুন রাজনীতি মানে আবার দেহের সমগ্রতার জন্য কোনো পেছনমুখো খায়েশ বা নস্টালজিয়া নয়। তিন, দেহের বিভিন্ন টুকরা নিয়ে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেহের টুকরাগুলোকে বিভিন্নভাবেই ব্যবহার করার ভেতরেই রয়েছে আধিপত্যবাদবিরোধী প্রাক্সিস্।

বাটলারের কথাগুলাতে বেশ চমক দেয়ার প্রবণতা খেয়াল করলাম। তবে যে দেহের কথা বাটলার বলছিলেন, তা পশ্চিমা মুলুকের বা ইউরোপের সাদা নারীর বিপর্যস্ত দেহ বটে, যে দেহের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের খেটে-খাওয়া নারীর শোষিত ও বিপন্ন দেহের নাক্ষত্রিক দূরত্ব। পুঁজি নারীর দেহকে কী অবস্থায় নিয়ে যায়, এমনকি আমেরিকার নারীদের দেহ কিভাবে শোষণের সার্কিটে প্রবেশ করে’ কি ধরনের চেহারা নেয়, ইত্যকার বিষয়ে বাটলারের সামান্যতম আগ্রহ দেখি নাই। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন বিকালে বাটলারকে আমার দারুণ ইউরোপকেন্দ্রিক বা শাদাকেন্দ্রিক মনে হয়েছিল। তবে এইবের প্রতিক্রিয়া একটি বাক্যেই এভাবে ব্যক্ত হয়েছিলঃ “বাটলারের কথায় দারুন সব ‘প্লে’ লক্ষ করছি”।

বলাই বাহুল্য, এই ‘প্লে’ হচ্ছে শব্দ ও অর্থকে অনন্তকাল ধরে পিচ্ছিল রাখার জন্য শব্দ ও ধ্বনির খেলাধুলা। ওই খেলাধুলা খানিকটা আর্নেস্তো লাকলাউয়ের বক্তৃতায় লক্ষ করা গেছে, তবে তা পরে ভীষণভাবে জমে উঠেছিল জাঁক দেরিদার বক্তৃতায়। লাকলাউ আলোচনা করলেন আধিপত্যবাদ ও রূপকের রাজনীতি নিয়ে। আলোচনাটা কোনো অংশেই জুডিথ বাটলারের আলোচনার চেয়ে কম জটিল নয়। তবে সহজ করেই বলার চেষ্টা করি। তিনি শুরু করলেন ভাষা কি করে হেজিমনি বা আধিপত্যবাদের বিভিন্ন সার্কিট তৈরি করে। তিনি জানালেন কীভাবে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক-কূটাভাস বা অন্যান্য ভাষিক অলংকার সমাজে আধিপত্য তৈরি করে।

অবশ্যই স্বীকার করি যে, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘ভাষা-দখল যে ক্ষমতা-দখলের আরেক নাম’—এমনি এক ধারণা নিয়ে আমি নিজেও লিখেছিলাম অনেক আগেই। তবে বিশেষ করে সেদিনের বিকালে লাকলাউ সাহেব ভাষার নামে লেখালেখিকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন যে মনে হলো, কেবল লেখালেখি করেই যেন জগৎ পাল্টানো সম্ভব হবে, কিংবা শব্দের খেলাধুলার মধ্যেই যেন প্রতিবাদের সর্বোচ্চ শক্তি নিহিত।

অবশ্যই আবারো বলি, লেখালেখি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে কেবল লেখালেখির ওপর একপেশে জোর দেয়ার ভেতর দিয়ে লাখো লাখো নিরক্ষর মানুষের জগৎ-পাল্টানোর সম্ভাব্য কাজকে প্রান্তে রেখে দেয়া হয় বা এমনকি তাদের এজেন্সিকেও অস্বীকার করার একধরনের ঝুঁকি তৈরি করা হয়। আমি বলতে চাচ্ছিনা যে, লাকলাউ-এর কাজের দৌড় এইখানেই। তিনি নিঃসন্দেহে একজন দারুণ মেধাবী তাত্ত্বিক। তার মেলা ধরনের কাজও আছে। তবে সেদিন বিকেলে তিনি শব্দ এবং লেখালেখি নিয়ে মেতেছিলেন বেশ। আর যারা কথাকেই কাজ মনে করেন, তারা লাকলাউ দ্বারা বেশ অনুপ্রাণিতও হয়েছিলেন। তবে চে গুয়েভারার সেই বিখ্যাত কথাটাও মনে এসেছিলঃ ‘কেবল শব্দ দিয়ে সমস্ত বিষয়ের মোকাবেলা সম্ভব নয়’।

লাকলাউয়ের বক্তৃতার পরে আবারও বিরতি। এ-সময় লাকলাউ ও বাটলার্ তাঁদের ভক্তদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। হাসছেন। দেরিদা তখনও আসেন নাই। হলের একটা কোণায় দাঁড়িয়ে আছেন জেমিসন। অবশ্যই বলতে হবে যে, জেমিসনের মধ্যে কোনো “আমি-কি-হনুরে” ভাব লক্ষ্য করি নাই মোটেই, যদিও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভীষণ বিখ্যাত। আমরা জেমিসনের দিকে এগুলাম। আমার সঙ্গে তার পরিচয় আরেকটা সূত্রে আগেই হয়েছে। জেমিসনের সঙ্গে এইবকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পরপরই তিনি নিজেই হেসে বললেন, ‘লাকলাউ খেপেছেন। বুদ্ধিমান লোক বটে। তবে যা কিছু রূপকায়িত তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন রূপককে’।

জেমিসনের সঙ্গে কিছুক্ষন কথা বলার পর এইব্ ও আমি আধঘণ্টা সময় পেয়ে ক্যাম্পাস ঘুরে আসি। সন্ধ্যা ৬টায় স্টেজে উপস্থিত হন জাঁক দেরিদা।

১৯৯৮ সালে তাঁর বয়স তখন আটষট্টি। দেরিদার তিনটি জিনিস চট করেই চোখে পড়েঃ তাঁর পাকা পাকা চুল, তাঁর দৃঢ় চোয়াল আর খাড়া নাক। বক্তৃতার বিষয় দেরিদা সাহেব নিজেই ঘোষণা করলেনঃ ‘টাইপরাইটার রিবনঃ লিমিটেড ইংক’।

নাটকীয় ভঙ্গি তাঁর বক্তৃতায় শুরু থেকেই। আর বক্তৃতা করছেন শুধু শব্দ দিয়ে নয়, দেহ দিয়েও। শব্দ ও বাক্যের ও দেহের ঘূর্ণি তৈরি করায় তুমুল উৎসাহ তাঁর। তাঁর শব্দের অর্থ কি সেটা বোঝার আগেই শুধু বোঝা যায় যে, শব্দ খইয়ের মতো ফুটে যাচ্ছে ক্লান্তিহীনভাবে। মনে হয় যতির চেয়ে গতি-ই বড়। মনে হয় পৃথিবীতে আর কিছু নাই কেবল শব্দের পর শব্দ সাজানো ছাড়া। আর অর্থ? অর্থের মৃতদেহের ওপর যেন দেরিদার শব্দের চঞ্চল নৃত্য। শব্দ (আওয়াজ অর্থে) দেখা যায়? হ্যাঁ, শব্দ দেখা যায় যদি দেরিদার বক্তৃতা শোনা যায়। কিন্তু শব্দ দেখে বলা যায় ‘চিনি উহারে?’ অনেকেই বলবেন ‘না’। তবে আমার পাশে বসে থাকা একজন ফিসফিস করে বললেন, ‘বুড়ার তেজ আছে বেশ’।

আমার জীবনের দীর্ঘতম বক্তৃতা শোনার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে দেরিদার ওই বক্তৃতার কথাই। তিনি শুরু করেছেন সন্ধ্যা ৬টায়। আর শেষ করেছেন রাত ১০টায়। কেউ কি কেবল ‘টাইপরাইটার রিবন’ নিয়ে টানা ৪ ঘণ্টা কথা বলতে পারেন? জাঁক দেরিদা নিজেই দেখালেন যে সেটা তিনি ভালোই পারেন। অবশ্য আমার সহপাঠী এইব্ তারাঙ্গো পরে আমাকে জানিয়েছিল যে তার এক প্রাক্তন শিক্ষক নাকি শুধু হাইডিগারের কোলন ব্যবহার নিয়ে টানা পাঁচ ঘণ্টা কথা বলেছিলেন। ওই গল্পটাকে অবশ্য এইবের নিজস্ব ধুনফুন ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় নাই। কিন্তু সত্যি সত্যিই জাঁক দেরিদা সেদিন টানা ৪ ঘণ্টা টাইপরাইটার রিবন নিয়ে কথা বলেছিলেন। বাকবিস্তার কাকে বলে এবং কত প্রকার, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দেরিদা সাহেব।

আবারও স্মরণ করা যাক দেরিদার বক্তৃতার পুরা শিরোনাম এবং উপশিরোনামটি—‘টাইপরাইটার রিবনঃ লিমিটেড ইংক’। দেরিদার বক্তৃতার শেষে আমি অবশ্য এইবকে বললাম, আসলে দেরিদার বক্তৃতার শিরোনাম এবং উপশিরোনাম হতে পারতো এমনটি—‘টাইপরাইটার রিবনঃ আনলিমিটেড ইংক’।

চার ঘণ্টা বক্তৃতা শোনার পর নিজেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত মনে হলো। এমনকি দেরিদা-ভক্ত এইবকেও বেশ ক্লান্ত দেখাল। সেটা স্বীকারও করল এইব্। তবে এও বলল, ‘কি চমৎকার বললেন জাঁক দেরিদা!’ ‘কিন্ত কি বললেন জাঁক দেরিদা?’ প্রশ্নটা আমিই ছুঁড়ে দিলাম। তখন পাশ থেকে আরেকজন আমাদের শোনালেন, ‘বহুদিন পর আবারও ভয়ানক মাথা ধরল’। এইবকে আমি যে প্রশ্ন করলাম তার উত্তরে সে বলল, ‘এতো অল্প সময়ে এখানে বসে তোমাকে দেরিদার বক্তব্য বোঝানো সম্ভব নয়’।

কিন্তু যা আদৌ বলা যায়, তা সহজেও, এমনকি সংক্ষেপে, বলা যায় না? যায়। আমিই বলবো এখানে, যদিও দেরিদা-ভক্তরা ও তথাকথিত উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা আমার বিরুদ্ধে সরলীকরণের অভিযোগ এনে বা ‘ডিকনস্ট্রাকশান’-এর বোমা মেরে আমার কথাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তা তারা করুক গিয়ে!

তবে চার ঘণ্টা ধরে যে কথাটা জাঁক দেরিদা আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, তা হল (আমার ভাষায়)ঃ চিহ্ন মোছারও চিহ্ন থাকে।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.