বাস্তবতা ও জাদুর সংমিশেলে যা পাই, তাই জাদুবাস্তববাদ? অথবা জাদুবাস্তববাদ সেই বাস্তবতাকে নির্দেশ করে, যা বাস্তবতার ভেতরে জাদুকে এমনভাবে ধারণ ...

জাদুবাস্তববাদ || আজফার হোসেন

8:34 AM Editor 0 Comments

বাস্তবতা ও জাদুর সংমিশেলে যা পাই, তাই জাদুবাস্তববাদ? অথবা জাদুবাস্তববাদ সেই বাস্তবতাকে নির্দেশ করে, যা বাস্তবতার ভেতরে জাদুকে এমনভাবে ধারণ করে যে, জাদুকেও বাস্তব বলে মনে হয়? কিংবা জাদুবাস্তববাদ কি 'বাস্তব' ও 'অবাস্তব' এবং 'সত্য' ও কল্পনার সনাতন যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোকে ধসিয়ে দেয়? একটি উপন্যাসে লোককাহিনী, গাথা, রুপকথা, প্রবাদ, প্রাচীন বচন, ভূতের গল্প, কিংবদন্তি ইত্যাদি ব্যবহার করলেই কি জাদুবাস্তবাদ পাওয়া যায়?

উত্তরে অনেকেই 'হ্যাঁ' বলেছেন। আর এই 'হ্যাঁ'-কে বিবেচনায় রাখলে বা গ্রহণ করলে যেসব কাজকে সাধারণত জাদুবাস্তববাদী বলে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য একেবারেই যে অধরা থেকে যাবে, তা কিন্তু নয়। তবে এভাবে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতাকে আপনাআপনি স্পষ্ট করা যাবে না। তাহলে সেই রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতাকে খানিকটা ধরার জন্য আমরা যেতে পারি আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং জাঁক স্তেফেন-অ্যালেক্সিসের কিছু পর্যবেক্ষণের কাছে।

কার্পেন্তিয়ের তার 'অনুপম বাস্তবতা'র ধারণাকে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি দিতে গিয়ে খুব সচেতনভাবেই ধ্রুপদী ইউরোপীয় বাস্তববাদের রাজনীতিকে আমলে রেখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাইতি'র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে--লড়াকু কালো আদমিদের উপনিবেশবাদবিরোধী ইতিহাসকে--খেয়ালে রেখেছেন এবং তার বহুমাত্রিক কিন্তু ইতিহাসে ময়লা-হয়ে-থাকা চেহারা ও চরিত্রকে ধরতে গিয়েই তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, একজন বালজাক বা একজন ডিকেন্স-এর বাস্তববাদ দিয়ে হাইতির বা কিউবার বা লাতিন আমেরিকার বাস্ততবতাকে ধরা মানেই নান্দনিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াকে জোরদার করা।

এই প্রসঙ্গে কার্পেন্তিয়ের অনেকটা কেপ ভার্দের বিপ্লবী কালো তাত্ত্বিক আমিলকার কাব্রালের মতোই উৎসে ফেরার আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু উৎসে ফেরাটাই--বা মার্কসের ভাষায় "র‍্যাডিকাল" হওয়াটা (মার্কস বলেছিলেন যে, র‍্যাডিকাল হচ্ছে সে, যে বিষয়ের একেবারে মূলে বা উৎসে হাত রেখে বিষয়কে সম্পূর্ণ ধরার চেষ্টা করে)--যথেষ্ট নয়। ফেরার চেয়েও জরুরি হয়ে থাকে আবারো গড়ার কাজ আর এই নির্মাণ পশ্চিমা বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বকে বা খোদ উপনিবেশবাদকে কেবল যে চ্যালেঞ্জ করবে তা নয়, বরং এই নির্মাণ সমাজের রুপান্তরের স্বার্থেই সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক করে তুলবে। এই ধরনের একাধিক ইঙ্গিত কার্পেন্তিয়েরের একাধিক কাজ থেকেই পাই বটে।

এবার আসি জাঁক স্তেফেন-অ্যালেক্সিস প্রসঙ্গে। তিনি হাইতির একজন লড়াকু ঔপন্যাসিক-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্ট। জাদুবাস্তববাদ নিয়ে একটি আস্ত রচনাই লিখেছেন তিনি। এর শিরোনাম 'অব দ্য ম্যাজিকাল রিয়ালিজম অব হেইশিয়ানস' অথবা 'হাইতিবাসীর জাদুবাস্তববাদ'। রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে।

এই রচনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে জড়ো করা যাক। প্রথমত, যাকে হাইতির জাদুবাস্তববাদ বলা হচ্ছে, তা একই সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অবস্থানের নাম।

দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন ও অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞ্যানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের স্বার্থে 'জাতীয় সংস্কৃতি' নির্মাণের কাজকে গুরুত্ব দেয়।

তৃতীয়ত, হাইতির জাদুবাস্তবাদ ও জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণের কাজে একই সঙ্গে যায় এই অর্থে যে, সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে হাইতির অধিকাংশ মানুষের--অর্থাৎ হাইতির কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের--জীবন-সংলগ্ন যেসব সাংস্কৃতিক উপাদান ও অনুশীলন উপেক্ষিত থাকে বা এমনকি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, সেগুলোকে সামুহিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে ফিরিয়ে এনে তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে পরখ ও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে জাদুবাস্তববাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

চতুর্থত, হাইতির জাদুবাস্তববাদের 'জাতীয়' বিষয়টা স্থানিক বিভিন্নতাকে মোটেই উপেক্ষা করে না। বরঞ্চ তা স্থানিক বৈচিত্র্যকে জায়গা করে দিয়েই ঐক্যের জায়গা খোঁজে।

পঞ্চমত, হাইতির জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণে জাদুবাস্তববাদের ভুমিকা পালনের সঙ্গে সরাসরি সামাজিক বিপ্লবের যোগ রয়েছে এই অর্থে যে, বিপ্লবকে এগোতে হলে তাকে অবশ্যই জনগোষ্ঠির মাটি-কাদা-জলের সঙ্গে এবং মনোজগতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হতে হবে। এই যুক্ততার কাজ স্তেফেন-অ্যালেক্সিসের মতে সংস্কৃতির লড়াকু কাজই বটে।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.