বছর কয়েক আগে আমার একটা লেখায় জীবনানন্দ দাশের দুইটা ছোটো গল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। দারুণ উপেক্ষিত দুইটা ছোটো গল্প। গল্প দুইটা...

জীবনানন্দ দাশের ছোট গল্প এবং কিছু প্রসঙ্গ || আজফার হোসেন

6:03 AM Editor 0 Comments


বছর কয়েক আগে আমার একটা লেখায় জীবনানন্দ দাশের দুইটা ছোটো গল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। দারুণ উপেক্ষিত দুইটা ছোটো গল্প। গল্প দুইটার নাম ‘হিসেব-নিকেশ’ এবং ‘কথা শুধু—কথা, কথা, কথা, কথা, কথা’। শেষের গল্পটা কিছুদিন আগে আবারও পড়লাম। এবং মনে হোলো ওই গল্পটার একটা ‘সিম্পটোম্যাটিক’ পাঠ সংক্ষেপে আবারও হাজির করি, ফেসবুকে আমার বন্ধুদের সঙ্গে সংহতির স্পিরিেটই।

তাহলে তাকানো যাক ওই গল্পটার দিকে, যার নাম ‘কথা শুধু—কথা, কথা, কথা, কথা, কথা’। এখানে ‘কথা’ শব্দটাকে অনায়াসে ‘টাকা’ পড়া যায়ঃ টাকা শুধু—টাকা, টাকা, টাকা, টাকা, টাকা। গল্পটা আন্তন চেকভ-এর ‘গুজবেরিস’ গল্পকে মনে করিয়ে দেয়, যে-গল্পে টাকার সঙ্গে ভাষার মিল খোঁজা হয়, যে-গল্পে টাকাই তো আসল কথা হয়ে ওঠে। চেকভ নিজেই বলেন, “ভদকার মতোই টাকা সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটায়”।

অন্যদিকে আবার জীবনানন্দ দাশের গল্পের ওই দুর্দান্ত, তুলনাহীন শিরোনাম কালো কবি ল্যাংস্টন হিউস-এর একটা ছোটো কবিতার কথাও মনে করিয়ে দেয়। কবিতাটাকে অবশ্য উল্টো দিক থেকে পড়ার কথা বলেছিলেন হিউস (বিশেষ করে নিচ থেকে উপর দিকে)ঃ

হাঁসফাঁস দামড়া হাঁস
পাড়ে

$$$$$
$$$$
$$$
$$
$

হ্যাঁ, ডলার বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে, n-পদ পর্যন্ত। এই বাড়াটাই আচ্ছন্ন করে রাখে ‘কথা শুধু’ গল্পের প্রধান চরিত্র ভবশঙ্করের মনোজগৎকে।

কিন্তু কে এই ভবশঙ্কর? ‘কথা শুধু’ গল্পের শুরুতেই জীবনানন্দ দাশ ভবশঙ্করকে পরিচয় করিয়ে দেন এভাবেঃ “ভবশঙ্কর একটা মস্ত বড় বাঙালি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান কিন্তু প্রত্যেক মিটিংয়েই সেক্রেটারি তাকে প্যাঁদায়”। প্যাঁদায়? জীবনানন্দের এই ‘প্যাঁদায়’ চিহ্নায়কটি যেন মুহূর্তেই বুদ্ধদেবীয় বাবু-বাংলাকে প্যাঁদাতে থাকে, এমনকি তার পোঁদে বা পাছায় লাথিও মারে।

সত্য, একবার কবিতায় জীবনানান্দ দাশ ‘ঠ্যাং’ শব্দটা ব্যবহার করাতে বুদ্ধদেবের বিস্ময় জেগেছিল (ইতিবাচক অর্থেই)। কিন্তু এও সত্য যে, ওই ‘প্যাঁদায়’ শব্দটা বুদ্ধদেবের ভাষিক মেজাজ থেকে তারার দূরত্বেই বিরাজ করে। এখানেই শেষ নয়। ওই দুইটা গল্পে জীবনানন্দ দাশ বেশ উৎসাহে ও উল্লাসে বেশ কিছু অনুকারাত্মক ও ধন্যাত্মক শব্দ ও পদ চালু রাখেন; শব্দগুলার একটা ফর্দ উপস্থিত করেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য এক সময় এভাবেঃ “হালু হালু, টস টস, ফ্যা ফ্যা, ফুঃ ফুঃ, হি হি, খুচ খুচ, ঢুই ঢুই এবং তৎসহ গজকন্দা, দমফাই, মেয়ে পটকানো, গয়ারাম, গুখখুরি”। এবং ‘প্যাঁদায়’।

তাহলে ফিরে আসা যাক জীবনানন্দ দাশের ‘কথা শুধু’ গল্পের ভবশঙ্করের কাছে। এই ভবশঙ্কর উৎপাদন-সম্পৃক্ত পুঁজি নিয়ে কারবার করে না; বরঞ্চ টাকা দিয়ে আরও টাকা আনার ব্যাপারটা মুখ্য হয়ে উঠে ভবশঙ্করের কাছে। ভবশঙ্কর সকালের চায়ে ঠোঁট ভেজায়, সুরুত সুরুত করে চুমুক দেয়, টোষ্টে তেলতেলে জেলি মাখায়, ডিমের হলদে কুসুমে দাঁত বসায়, তারপর কামড়ে ধরে কলা। এরপর গুলতি মারার মতোই সে শব্দ মারেঃ “বিজনেসে লেগে থাকলে এই হবে শুধু—টাকা হবে, আরও টাকা হবে, আরও টাকা হবে, আরও টাকা হবে”।

ভবশঙ্করের জবানে জীবনানন্দ যে বয়ান পুরে দিয়েছেন, তা যেন কার্ল মার্কসের M-M’-এর প্রতিধ্বনি তোলে বারবার (যেখানে M মানে টাকা আর M’ মানে টাকা)। আর ওই M-M’ এর স্বার্থেই ভবশঙ্কর ভোল পাল্টাতে দ্বিধাবোধ করে না মোটেইঃ সে তার ফটকাবাজি বিভিন্ন এলাকায় জারি রাখে। উদাহরণ হিসাবে বলা যাবে আলবার্ট হলে লেফটদের সামনে ভবশঙ্করের বক্তৃতার কথা। প্রথমে সে ভুলে বলে ফেলে, “আমি বলশেভিক নই”। আর যায় কোথায়? অমনি আমজনতার শোরগোল ও ধিক্কার ওঠে। কিন্তু নিমেষেই ভবশঙ্কর ভোল পালটায়। জীবনানন্দ নিজেই তার গল্পে জানান দেনঃ “রাশিয়ার চাষাভুষোর গুণগান করলেন ভবশঙ্কর। নিতান্ত নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সোভিয়েতের গুণগান করলে, বলশেভিকদের জয়জয় করলে। জয়জয়কার পড়ে গেল ভবশঙ্করের”।

একেবারে ফটকাবাজির ওপর চোখ রেখেছেন জীবনানন্দ দাশ আর ধরিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ভদকার মতোই টাকা সব অদ্ভুত কারবার করে।

টাকা কী কী করতে পারে তা বোঝানোর জন্য কার্ল মার্কস মাঝে মাঝে বেশ আগ্রহ নিয়ে শেক্সপিয়রকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর _ইকনমিক অ্যান্ড ফিলসফিক্যাল ম্যানিউস্ক্রিপটস_ নামের বইয়ে মার্কস দারুণভাবে টুকে দিয়েছেন শেক্সপিয়রের নাটক _টাইমন অফ এথেন্স_ থেকে বেশ কিছু লাইন। এভাবেই মার্কস বুঝিয়েছেন যে, টাকার জোরে এমনকি নিজের মুখ নিজের পোঁদকে চুমু খায়। আর টাকাকে বলা হয়েছে “দৃশ্যমান হলুদিয়া আল্লাহ”।

জীবনানন্দ দাশও তাঁর কিছু গল্পে ওই মুখ ও পোঁদের চুমাচুমির মুহূর্তকে পুঁজিবাদের একটা বিশেষ পর্বে খপ করেই ধরে ফেলেছেন, যে গল্পগুলোকে তাঁর অন্যান্য গল্প থেকে অনেক আলাদা মনে হয়।

এই অন্য স্বরের, অন্য সুরের, অন্য ভাষার এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির জীবনানন্দ দাশকেও চিনে রাখা দরকার।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.