বিশ্বসাহিত্য ও তুলনামূলক সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে উনিশ ও বিশ শতকে আমি এমন কোনো কবির সন্ধান পাইনি, যিনি ফর্ম ও বিষয়ের বিস্তার ও বৈচিত্র্য...

এবং রবীন্দ্রনাথ

8:05 AM Editor 0 Comments

বিশ্বসাহিত্য ও তুলনামূলক সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে উনিশ ও বিশ শতকে আমি এমন কোনো কবির সন্ধান পাইনি, যিনি ফর্ম ও বিষয়ের বিস্তার ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে টপকাতে পারেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও নিবন্ধের কথাও সঙ্গত কারণেই চলে আসে। প্রথমত ও প্রধানত কবি ও গীতিকার হলেও রবীন্দ্রনাথের কাজের বিশাল জায়গা জুড়ে থাকে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোট রচনাসহ অনেক চিঠি। এসব কাজ রবীন্দ্রনাথের বিষয়বৈচিত্র্য ও বিস্তারকেই নির্দেশ করে বটে।

একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনি ভারতের ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে ইউক্লিডের সরলরেখার দৌড় দেখিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে অকেজোও প্রমাণ করেছেন। উত্তারাধুনিকতাবাদীদের কেউ কেউ হয়তো ১৯১১ সালে লিখিত রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ 'ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা'র এই পঙক্তিতে বেশ মজা পাবেন: "সোজা লাইনের সমাপ্তিহীনতা, সোজা লাইনের অতি তীব্র তীক্ষ্ণ কৃশতা বিশ্ব প্রকৃতির নহে"। অবশ্য 'উত্তরবাদী' ও সাবঅলটার্ন  ইতিহাসতাত্ত্বিক রণজিৎ গুহের পোয়াবারো হয়েছে এর মধ্যেইঃ তিনি রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসতত্ত্ব নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ বই লিখে ফেলেছেন। এছাড়া যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন গণিত ও সঙ্গীতের মিল নিয়ে, ঠিক তেমনি তিনি লিখেছেন ভেষজবিদ্যা ও সংস্কৃতির 'অত্যুক্তি' নিয়ে। আবার যেমন তিনি লিখেছেন কৃষি ও পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এবং যেমন তিনি লিখেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশ নিয়ে, তেমনি লিখেছেন তিনি ছেলে-ভুলানো ছড়া নিয়ে, শূন্যের মাজেজা নিয়ে, দান্তের বিয়াত্রিচ ও পেত্রার্কের লরা নিয়ে, কবিওয়ালাদের গান নিয়ে, ব্যঙ্গ ও কৌতকের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব নিয়ে, নীতিবিদ্যা নিয়ে, বিশ্বসাহিত্য নিয়ে, জাতীয় সাহিত্য নিয়ে, সমালোচনা ও সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে। এমনকি তিনি ১৯৩৪ সালে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে একটি ছোট্ট ভক্তিমূলক রচনা লিখেছেন, যেখানে তিনি ইসলামকে বড় ধর্ম ও শান্তির ধর্ম হিসেবে দেখেছেন। অন্যদিকে তিনি ১৯৩৬ সালে পঞ্চম জর্জকে নিয়ে প্রশস্তিমূলক বাক্য রচনা করেছেন নির্দ্বিধায়। আর শিক্ষা তো রবীন্দ্রনাথের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। কমপক্ষে পঞ্চাশটির বেশি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন ওই বিষয়ের ওপর। 

এছাড়া রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও পুরুষতন্ত্র নিয়েও, তাঁর নিজস্ব মানবতাবাদী অবস্থান থেকেই। হ্যাঁ, ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি 'ইম্পীরিয়ালিজম' শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেন, যেমন ১৮৯২ সালে তিনি লিখেন 'ক্যাথলিক সোশ্যালিজম'ও ১৮৯৩ সালে 'স্যোশ্যালিজম' শিরোনামের প্রবন্ধ। ওই ১৮৯২ সালেই রবীন্দ্রনাথ আরেকটি প্রবন্ধ লিখেন, যার শিরোনাম 'আমেরিকানের রক্তপিপাসা'। প্রবন্ধটির শিরোনামই তার প্রতিপাদ্য বিষয়কে সরবে ঘোষণা করে। রবীন্দ্রভক্তদের কেউ কেউ এও মনে করেন যে, রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে 'অরাবীন্দ্রিক' ভাষা ব্যবহার করেছেন এভাবে: "মনুষ্যজাতির মধ্যে একটি বিষ আছে; যখন এক জাতি আর এক জাতিকে আহার করিতে বসে, তখন ভক্ষ্য জাতি মরে এবং ভক্ষক জাতির শরীরেও বিষ প্রবেশ করে। আমেরিকানদের রক্তের মধ্যে বিষ গেছে"। আসলে রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র-সংস্কৃতি নিয়ে ২০০২ সালে তৈরি-করা মাইকেল মুরের একটি প্রামাণ্য ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই ছবির শিরোনাম বোলিং ফর কলাম্বাইন। এও বলা দরকার, ওই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বেশ জোরেশোরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ-আক্রান্ত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত কৃষ্ণাঙ্গদের ও আদিবাসীদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন।

ওপরে দেওয়া ফর্দটি মোটেই পর্যাপ্ত নয়। তবে এটি পরিষ্কার, রবীন্দ্রনাথ কত শত বিষয় নিয়ে ভেবেছেন ও লিখেছেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত ও একমাত্রিক চরিত্রায়ণ যেমন ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি সহজ হয়ে পড়ে তার স্ববিরোধিতা শনাক্ত করাও। অবশ্যই স্ববিরোধিতাকে দেখানোর জন্যই কেবল স্ববিরোধিতাকে চিহ্নিত করা কাজের কাজ নয়। তবে রবীন্দ্রনাথের বিষয়বৈচিত্র্য নিজেই ওই প্রশ্নটাকে সামনে আনতে সাহায্য করে: কোন রবীন্দ্রনাথ? আর সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কাজ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বৈকি। আর তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা নয়। বরং বর্তমান সময়ের তাগিদেই ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাঁকে সম্পর্কিত করার লক্ষ্যেই তাঁর সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া জরুরি হয়ে পড়ে। এ বোঝাপড়ার জন্য তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধকে যথেষ্ট ব্যবহার করা যায়। সত্য, রবীন্দ্রনাথের 'সৃজনশীল' এবং 'মননশীল' রচনার মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন-রেখা এঁকে দিয়ে গত অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গান-উপন্যাস-গল্প-ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে যতটা কথাবার্তা ও লেখালেখি এবং গবেষণা করেছেন, তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে ততটা তাঁরা করেননি, যদিও তাঁর প্রচুর শক্তিশালী প্রবন্ধ ও নিবন্ধ রয়েছে, তাত্ত্বিক প্রবন্ধসহ।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.