আমার শিক্ষকতার জীবনে এটা এখন এক ধরনের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছেঃ অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের গ্রাজুয়েশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার দিনটায় তাদের কেউ কেউ আ...

দুটি অভিজ্ঞতা - আজফার হোসেন

5:52 AM Editor 0 Comments

আমার শিক্ষকতার জীবনে এটা এখন এক ধরনের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছেঃ অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের গ্রাজুয়েশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার দিনটায় তাদের কেউ কেউ আমাকে সঙ্গে নিয়ে হৈচৈ করতে করতে ছুটে চলে যায় শহরের কোনো এক রেস্টুরেন্টে বা বারে।

তবে উদ্দেশ্য শুধু খাওয়া-দাওয়া আর পান করা নয়, আড্ডা মারাও। তো, সেদিন আড্ডা মারার জন্য আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়েছিল আমার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের তিন জনঃ পিটার ব্যারোস, আনা ক্রাট ও লরেন ইয়েঞ্জ।

বেশ সময় ধরে চললো তুমুল আড্ডা। যদিও ওই ‘আড্ডা’ শব্দের সঙ্গে বা তার সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গের সাথে এদের কারুরই পরিচয় ছিল না। সেটা না থাকারই কথা। আর ‘আড্ডা’ শব্দের সঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ নাই বলেই আমার বিশ্বাস। তবে তাদের আমি বোঝাবার চেষ্টা করি ‘আড্ডা’ জিনিসটা কি।
আমাদের কথাবার্তা চলার এক সময় হঠাৎ করে আনা বিপ্লবী রাজনীতিতে আমার সার্বক্ষণিক আগ্রহ বিষয়ে জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেঃ “এই আগ্রহটা কি তোমার অল্প বয়স থেকেই?”

দপ করে কয়েকটা বিশেষ দিন, একেবারে শৈশবের দিন, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে! জীবনে প্রথম মিছিলে যোগ দেয়ার কথাটা মনে পড়ে যায়। ওটা ছিল দীর্ঘ মশাল মিছিল।

পেছনে তাকিয়ে এখন অনায়াসে বলতে পারি, ওটা ছিল আমার রক্তের ভেতরে শিবের প্রথম নাচ। পেছনে তাকিয়ে এও বলতে পারি, রংপুর শহরের মূল রাস্তায় নামা জনতার ঢলে মশাল হাতে মিশে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো অনুভব করেছিলাম মানুষের ঐক্যবদ্ধ সম্পর্কের সে এক অভাবনীয় শক্তি, সমতার সাবলীল আনন্দ এবং এমনকি ভোরের আলোর মতোই তার সৌন্দর্যও, যদিও সন্ধ্যা তখন ছড়িয়ে পড়ছে শহরের উপর।

আর সেই সন্ধ্যায় আমার বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে আমার মতো একজন শিশুকে ওইভাবে মিছিলে দেখে অনেকেই একইসঙ্গে যে আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েছিলেন, সেটা তখন ওই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম।

আর আমার বয়স কত ছিল তখন? মাত্র ৬ বছর। আর সেই উত্তাল ঐতিহাসিক সময়টা ছিল ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের।

হ্যাঁ, ওটা ছিল ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রকাশ হিসাবেই রংপুর শহরের এক বিশেষ মশাল মিছিল, যা ছিল আমার জীবনের প্রথম মিছিল।

আরেক দিনের কথাও মনে এল। তখন ৭০ সাল। থাকি ফরিদপুর নামের এক বিবর্ণ ভাঙাচোরা মফস্বল শহরে। আমার গরীব বাবামামা তখন প্রচণ্ড কষ্টে সংসার চালাতেন সেই শহরে।

তো, আমার স্মৃতির, স্বপ্নের আর দুঃস্বপ্নের সেই শহরে নেমেছিল আবারও মানুষের ঢল। একেবারে মূল রাস্তায়। কিন্তু না, ঠিক রাস্তার মাঝখানে নয়, রাস্তার দুপাশে। যেন বিশেষ ছন্দে কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে স্পন্দিত মানুষের ঢেউ জেগে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে রাস্তার দুই পাশে। কেননা ওই রাস্তা দিয়ে আসবেন প্রায় ঈশ্বরের মতো একজন মানুষ—বা মানুষের মতো একজন ঈশ্বর!

আসবেন তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে। যাবেন তিনি অন্যত্র তাঁর নিজের শহরের ভেতর দিয়েই। আ্রর তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য কিংবা তার সঙ্গে ভালবাসায় হাত মিলাবার জন্য রাস্তার দুই পাশে অধীর অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সহজ সরল সুন্দর মানুষ।

আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসায় প্রতিটা মানুষ সুন্দর হয়ে ওঠে। আমি সেদিন ভালোবাসায় সুন্দর হয়ে ওঠা মানুষের ঢল দেখেছিলাম।

কিন্তু কার জন্য রাস্তায় নেমেছিল এই সব সুন্দর মানুষের ঢল? কার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল জনতার আনন্দের আর অপেক্ষার সেই প্রাণপ্রাচুর্য-ভরা মহাকাব্য? কে ছিলেন সেই ঈশ্বরের মতো একজন মানুষ—বা মানুষের মতো একজন ঈশ্বর?

তিনি ছিলেন খোদ শেখ মুজিবুর রহমান।

অতঃপর তাঁর শাদা গাড়ি শহরে প্রবেশ করলো। বলতে পারবো না আসলে কতোটা লম্বা ছিল মানুষের লাইন! কিন্তু সেই লাইনের এক জায়গায় আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম তাঁকে এক ঝলক দেখবো বলে।

আর আমাদের গোয়ালচামোট এলাকায় তাঁর শাদা গাড়িটা পৌঁছুতেই দেখলাম সেটা চলছিল গরুর গাড়ির চেয়েও ধীরে, এমনকি থেমে থেমেও। কেননা ভালবাসায় উদ্বেলিত, সিক্ত, আনন্দিত, প্রাণিত শেখ মুজিব সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মিলাচ্ছিলেন একের পর এক।

সেই প্রথম দেখি তাঁকে! জনতার এত আনন্দ, এত উত্তেজনা জীবনে খুব কমই দেখেছি, বলতে হবে। আর এই আনন্দিত জনতার ভেতর থেকে কী করে যেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আমিও হ্যান্ডশেক করে ফেললাম। কয়েক সেকেন্ড তিনি আমার হাত ধরে রেখেছিলেন, মনে পড়ে। পেছনে তাকিয়ে আজ মনে হয়, হয়ত শিশু বলেই আমি খানিকটা অগ্রাধিকার পেয়েছিলাম সেখানে।

শৈশবের এই স্মৃতিটা আমার সঙ্গে থেকে যাবে ‘অনন্ত’কাল ধরে, যদিও এও সত্য যে, পরবর্তী জীবনে মুজিবের ঐতিহাসিক অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার না করে তাকে নিয়ে প্রশ্নও তুলেছি বারবার, ঝুঁকি নিয়েই। এবং অবশ্যই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নীতির সঙ্গে গাদ্দারি-করা আওয়ামী লীগের—ও বি এন পি’রও— গণবিরোধী রাজনীতির বিরোধিতা করে এসেছি। করে যাবও।

এবারে বলি মন-আর-ইন্দ্রিয়-ঝাঁকি-দেয়া আরেক বিরল অভিজ্ঞতার কথা।

সেটা একাত্তরের পরের ঘটনা।

সেদিন আমার মাওবাদী এক চাচা আমাকে নিয়ে গেলেন একজনের বক্তৃতা শোনাতে। তিনি আমার দুঃসম্পর্কের চাচা হলেও এক সময় আমার সঙ্গে তিনি বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাঝে মাঝে আমার নানার গ্রামের বাড়িতে এসে আমার সেই শিশু বয়সের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতায় তিনি চোখ বুলাতেন। আর বাহবা দিতেন। আর মজা করে আমাকে ডাকতেন ‘আমাদের তরুণতম মুক্তিযোদ্ধা’ বলে!

তো, সেদিন আমার সেই কাশেম চাচার সঙ্গে গিয়েছিলাম শুধু বক্তৃতা শুনতেই নয়, বক্তৃতা শোনার জন্য নামা জনতার ঢলের সঙ্গে মিশে যেতেও।

এবারও আসবেন বিশেষ একজন। এসে বক্তৃতা করবেন। এবারও জনতা দারুণ উদ্গ্রীব। অতঃপর তিনি এলেন। স্পষ্ট মনে আছে যে, সেই ভীষণ অল্প বয়সেই মনে হয়েছিল, তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যেন আল্লাহ্‌’র এক পরম আশীর্বাদ, এক পরম মেহেরবানি, নেমে এসেছে এই ধরায়! তাঁর সেই অলৌকিক কিন্তু সাক্ষাৎ উপস্থিতিতে তিনি নিজেই যেন হয়ে উঠেছিলেন নূর, নূহ ও নজরুলের সম্মিলন!

দাড়িওয়ালা নজরুল? কিছুটা দূর থেকে তাঁকে দেখে তাও মনে হচ্ছিল। (বলা দরকার, আমি তখন সেই বয়সেই নজরুলের ছড়া আর কবিতার ভীষণ ভক্ত। আর কাশেম চাচাও আগেই বিদ্রোহী নজরুল নিয়ে আমাকে একাধিক গল্প শুনিয়েছেন।)

সেদিন আমার ওই অল্প বয়সেই তাঁর বক্তৃতা শুনে বুঝে গিয়েছিলাম, তিনি আমার প্রায়-ভুমিহীন দাদার কথা বলছিলেন অবলীলায়, আমার নানার কথাও বলছিলেন তিনি, অর্থাৎ বলছিলেন মেহনতি মানুষের কথা, বিশেষ করে বাংলার কৃষকের কথা, যে-কৃষকের রক্ত আমার দেহে বয়ে যায় আর বলকায়।

হ্যাঁ, তাঁর বক্তৃতা শুনে একসময় মনে হল, আমার রক্ত রীতিমত বলকাচ্ছে। এখনও বলকায়। বলকায় বলকায় বলকায় বলকায় বলকায় (যখন তোমরা মেতে থাক বিকেলের রূপ নিয়ে চিল্কায়!)।

আমার সেই বলকানো রক্ত —তাঁর সেই বক্তৃতার কারণেই—এমনকি মাও-এর ডাকও শুনতে পায় ভররাতে। আর সত্যিই তো, সেই বিকেলে তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, “বল্লমের মতো ঝলসে উঠছিল তাঁর হাত বারবার”।

আর সেই বক্তৃতা থেকে তিনটি ‘জ’-শব্দ আলোকচ্ছটার মত ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিলঃ জমি, জলা, জাল। তবে তারা তো শধু শব্দ নয়!

কিন্তু কে দিয়েছিলেন মেহনতি মানুষের ঘামে-ভেজা কিন্তু টগবগ-করা আর তাদেরই বুকের কথা-ভরা সেই বক্তৃতাটা? নূহ নবী নিজেই? নাকি নয়া নজরুল? নাকি সফেদ পাঞ্জাবিতে অটল থাকা মজলুম জননেতা?

অনেক পরে তাঁকে নিয়ে লেখা শামসুর রাহমানের একটা দুর্দান্ত কবিতা পড়ে আন্দোলিত হয়ে রাহমান ভাইকে এক সময় মজা করে বলেছিলাম (আর কথাটা শুনে তিনি হেসেছিলেনও)ঃ “আপনে দেখছি আমার শিশু বয়সের অনুভূতি আর অভিজ্ঞতাকে খানিকটা চুরি করে ভাসানী নিয়ে কবিতাটা লিখেছেন!”
হাঁ, তিনি ছিলেন ভাসানী। মউলানা ভাসানী।

আর তাঁর সেই বক্তৃতাটা ছিল আমার জীবনে শোনা তাঁর প্রথম ও শেষ বক্তৃতা।

কিন্তু জানি না, সেদিনের সেই খানিকটা অচেনা মেট্রোপলিটন রাতে, এক পশ্চিমা রেস্টুরেন্টে বসে, ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে-থাকা আমার বিদেশী ছাত্রছাত্রীদেরকে—পিটার, আনা আর লরেনকে—আমার সেই সব স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার কথা ঠিকঠাক বলতে পেরেছিলাম কিনা!

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.