বৃষ্টি নিয়ে দুটি অনুবাদ কবিতা ।। আজফার হোসেন
বৃষ্টি হচ্ছে
মূলঃ বিসেন্তে আলেইহান্দ্রে
অনুবাদঃ আজফার হোসেন
এই সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছে, আর তোমার যে ছবিটা
তুলেছিলাম তাও ঝরছে আজ বৃষ্টি হয়ে।
দিনটা হুট করে খুলে যায় আমার স্মৃতিতে।
ভেতরে হেঁটে আসো। অথচ আমি কোনো আওয়াজ পাই না।
স্মৃতি আমাকে তোমার ছবি ছাড়া দেয় না তো কিছুই।
সেখানে কেবল তোমার চুম্বন ঝরছে, অথবা ঝরছে বৃষ্টি।
তোমার কণ্ঠস্বর বৃষ্টি হয়ে ঝরছে
তোমার বিষণ্ণ চুম্বন বৃষ্টি হয়ে ঝরছে
গভীর চুম্বন, বৃষ্টিতে ভেজা চুম্বন। ভেজা ভেজা ঠোঁট।
স্মৃতিতে ভিজে ভিজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে চুম্বন
কোনো এক ছাইরং মোলায়েম আকাশ থেকে।
তোমার প্রেম থেকে ঝরে বৃষ্টি, আমার স্মৃতিকে
ভিজিয়ে দিয়েই বৃষ্টি পড়তেই থাকে। অনেক নিচে
চুম্বন পড়ে। ধূসর বৃষ্টি
ঝরেই চলেছে।
বৃষ্টিবন্দনা
মূল: পাবলো নেরুদা
অনুবাদ: আজফার হোসেন
বৃষ্টি ফিরে এলো
আকাশ থেকে নয়
কিংবা পশ্চিম দিগন্ত থেকে নয়,
সরাসরি এলো আমার শৈশব থেকে।
রাত্রি ফেটে গেল, বজ্রের রোল
বারবার জোরালো আওয়াজ
প্রতিটি নির্জন অলিগলি ভাসিয়ে নিল,
এবং তখন
বৃষ্টি এলো
আমার শৈশব থেকে
ফিরে,
প্রথমে
এক গর্জে ওঠা
ঝাপটা,
তারপর
এক পৃথিবীর
ভেজা
লেজুড়।
বৃষ্টি
পড়ে টপটপ, হাজারো ফোঁটা
ভারি হাতুড়ি
কিংবা রাতে কালো পাপড়ির
ভীষণ ঝুরঝুর ঝরে-পড়া,
হঠাৎ করে
তীব্র,
পাতাগুলোকে
সুঁই দিয়ে
বিদ্ধ করে চলেছে;
অন্যসময় সে
এক ঝোড়ো
আলখিল্লা
নৈঃশব্দে
ঝুলে পড়ছে।
বৃষ্টি
বাতাসের সাগর
তাজা টাটকা
ন্যাংটা গোলাপ
আসমানি জবান,
কালো বেহালা,
কেবলই সুন্দর:
শৈশব থেকেই
তোমায় আমি ভালোবেসেছি
কেবল তোমার গুণের জন্য নয়
তোমার সৌন্দর্যের জন্যও।
আমার ক্ষয়রোগের জুতায়
পা টেনে টেনে চললাম
যখন ঝরঝর আকাশের
ফিতেগুলো
আমার মাথার উপর
উন্মোচিত হল।
উপর থেকে
নিয়ে এল বাণী
আমার কাছে, উৎসের কাছে,
ভ্যাপসা অক্সিজেন
জঙ্গলের আজাদি।
আমি জানি
তুমি কতোটা মঙ্গলহীন হতে পার,
ছাদের ছিদ্র বেয়ে
পরিমিত ঝরঝর ফোটায়
নামতে পার
দীনহীন গরীব মানুষের
ঘরে ঘরে।
ঠিক তখনই তোমার সৌন্দর্যের মুখোশ
খসে পড়ে
যখন তুমি
বেহেশতি বর্মের মতো
নিচমনা
অথবা কাঁচের
ধারালো চাকু।
ঠিক সেখানেই তোমাকে আমি
চিনতে শিখলাম।
কিন্তু
প্রেমে
তমসায়
আমি তো তারপরও
তোমারই ছিলাম।
চোখ পুরা বন্ধ করে
আশা করেছিলাম তুমি ঝরবে
পৃথিবীর উপর।
ভেবেছিলাম তুমি কেবল আমার
কানের জন্য গাইবে গান।
কারণ আমার হৃদয় প্রতিপালন করেছিল
জামির নবোদ্গম, তার মঞ্জুরি
কারণ আমার হৃদয়ে সোনা-রূপা-তামা এক হয়
কারণ আমার হৃদয় থেকে জেগে ওঠে গমের দানা।
কিন্তু তারপরও তোমার প্রতি এই ভালোবাসায়
মুখে রেখে যায় তিক্তস্বাদ--
আফসোসের তিক্ত স্বাদ
ঠিক গত রাতেই
এইখানে, সান্তিয়াগোতে
ন্যুভো লেগুয়ার
বাড়িগুলো
ধ্বসে পড়ল,
যেন ঠুনকো
ব্যাঙের ছাতা,
যেন লাঞ্ছনার
স্তুপ।
তোমার গমগম ভারি পদশব্দের কারণে
তারা ধসে পড়ল,
শিশুদের
পাঁকে ডোবা
কান্নার আওয়াজ
এবং দিনের পর দিন
বৃষ্টি-ভেজা বিছানায়
চুরমার চেয়ারগুলোয়
নারীরা
হেঁসেলের অগ্ন্যুৎসব--
যেখানে তুমি কালো বৃষ্টি,
জুলুমবাজ বৃষ্টি
পড়তেই থাকলে
আমাদের দুর্দশার ওপর।
আমি বিশ্বাস করি
আসবে একদিন--
আমরা পঞ্জিকায় দাগিয়ে রাখবো সেই দিন--
যখন নিরাপদ চালের নিচে
শুকনো ছাদের নিচে
স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাবে মানুষেরা--
সবাই ঘুমাবে
যখন রাতের মাঝখানে
বৃষ্টি
ফিরে আসবে
আমার শৈশব থেকে,
সে গাইবে গান
অন্য শিশুদের শোনানোর জন্য
আর পৃথিবীর ওপর পড়তে-থাকা
বৃষ্টির গান
আনন্দমুখর হবে।
বৃষ্টি তখন মেহনতি হবে,
প্রোলেতারিয়েত বৃষ্টি,
মজে থাকবে
উর্বর পাহাড়ে-পাহাড়ে
সমতলে-সমতলে
নতুন জীবন-দেয়া নদীতে-নদীতে,
ফেস্টুনের মতো গাঁথবে
ক্ষয়ে-যাওয়া চিকন গিরিখাত সব,
পাহাড়ে যা বিস্তৃতির অতলে ছিল--
প্রবল বাতাসের তুষারিয়া প্রবহে
কঠিন কাজে লিপ্ত হবে,
নাচবে
গরু বাছুরের পিঠে পিঠে
করবে
গমের বসন্ত বীজকে
বলবান,
গোসল সারাবে
গোপন এ্যামন্ড গাছগুলোর,
পৃথিবীর সব প্রস্তুতিতে
পুরাদমে বৃষ্টি
কৌশলী সুক্ষ্মতায় কাজ করে যাবে
তার সমস্ত হাত আর সুতা দিয়ে।
বৃষ্টি
গতকালের বৃষ্টি
'লনকোচ' আর 'টেমুকো’র
হে বিষণ্ণ বৃষ্টি
গেয়ে যাও গান
গেয়ে যাও গান
গান গাও ছাদের ওপর
গান গাও গাছের পাতায়-পাতায়
গাও গান
কাঁপন-ধরা বাতাসে বাতাসে
গান গাও আমার হৃদয়ে
গান গাও, গাও, আমার ঈমানের ভেতর
আমার ছাদে, আমার শিরায়-শিরায়
আমার সারা জীবনের ভেতর দিয়ে
গেয়ে যাও গান।
আমি তোমাকে ডরাই না আর, হে বৃষ্টি:
যাও চলে, মাটির দিকে
তাক করে
তোমার আর আমার
গান গেয়ে।
এইসব বীজ নিয়ে
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.